সরকার আলু চাষিদের উৎপাদন খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে হিমাগারের গেটে আলুর বিক্রয় মূল্য প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে। তবে সরকারের নির্ধারিত দামে হিমাগার গেটে আলু বিক্রি হচ্ছে না। হিমাগার গেটে ১২ থেকে ১৪ টাকা এবং খুচরা বাজারে ২০ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে।
গত বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কৃষি মন্ত্রণালয় হিমাগারের গেটে প্রতি কেজি আলুর সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা এবং ৫০ হাজার টন আলু কেনার ঘোষণা দেয়। এ ঘোষণা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে-এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
এদিকে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নভেম্বরের শেষের দিকে আগাম নতুন আলু উঠবে। তখন পুরাতন আলুর চাহিদা অনেক কমে যাবে। তাই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ অনুযায়ী আলু বিক্রি না হলে ব্যবসায়ী, কৃষক ও হিমাগার মালিকদের লোকসানে পড়তে হবে।
রংপুর নগরীর ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেন, আবুল কালাম স্থানীয় একটি হিমাগারে প্রায় ৩ হাজার বস্তা আলু রেখেছিলেন। সরকার ২২ টাকা কেজি নির্ধারণ করে দেওয়ায় কিছুটা আশার আলো দেখেছিলেন। সোমবার হিমাগারে গিয়ে দেখে প্রতিকেজি আলু ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ফলে তারা আলু বিক্রি না করেই চলে আসেন।
গঙ্গাচড়া উপজেলা গজঘণ্টা ইউনিয়নের আলু চাষি বাবুল মিয়া, আবু হানিফ হিমাগারে আলু রেখেছিলেন। লোকসানের ভয়ে আলু হিমাগার থেকে উত্তোলন করেন। সরকারি ঘোষণায় তারা হিমাগার গেটে আলু বিক্রি করতে গিয়ে দেখেন নির্ধারিত দামে আলু বিক্রি হচ্ছে না। সংসারের খরচ মিটাতে লোকসান দিয়ে সামান্য কিছু আলু বিক্রি করেছেন।
মিজানুর রহমান স্থানীয় একটি হিমাগারে ১২০০ বস্তা আলু রেখেছিলেন। কৃষকের জমি থেকে আলু ক্রয়, বস্তা-বাঁধাই, লেবার, হিমাগার ভাড়াসহ তার মোট খরচ পড়েছিল ২২ লাখ টাকা। বর্তমান বাজার দরে আলু বিক্রি করলে তার ঘরে আসবে আট লাখ টাকা। পুঁজি থেকে চলে যাবে ১৪ লাখ টাকা। তিনি এখন কী করবেন, এই চিন্তায় দিশেহারা। তার মতো অনেকেই আলুর আবাদ করে পথে বসেছেন।
রংপুর সিটি বাজারের অন্যতম আড়তদার মো. নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের হিমাগার গেটে আলুর সর্বনিম্ন দাম ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কোথাও মানা হচ্ছে না। প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে পাইকারি ১২ টাকা থেকে সাড়ে ১৪ টাকায়। ১ বস্তা আলু হিমাগার থেকে নিয়ে আড়ত পর্যন্ত আসতে আরও খরচ আছে প্রায় ১২০ টাকা। পরে পাইকারিতে লাভ হচ্ছে না। অপরদিকে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলু ১৮ থেকে ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিঠা পুকুরের উত্তমাশা কোল্ড স্টোরেজ প্রা. লি. এর প্রোপাইটার মো. ওবায়দুল হক বলেন, তার হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ মেট্রিক টনের কিছু বেশি। সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন দামের চেয়েও অনেক কম দামে আলু বিক্রয় হচ্ছে। কৃষকরা ভালো মূল্য না পেলে বিপাকে পড়বেন হিমাগার মালিকরা। কারণ অধিকাংশ হিমাগার চালাতে ঋণ করতে হয়েছে। আবার অনেক কৃষক ও ব্যবসায়ীকে আলু বাবদ ঋণ দেওয়া হয়েছে।
কৃষকরা জানান, এক দোন (২২ শতক) জমিতে আলুর বীজ লাগে ২৪ হাজার টাকার। রোপণ, সার, উত্তোলন ইত্যাদির খরচ পরে ১৯ হাজার টাকা। এক দোন জমিতে মোট খরচ হয় ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। উৎপাদন হয় ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ কেজি। সেই হিসেবে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়ে ১৯ থেকে ২০ টাকা। হিমাগারে আলু রাখলে কেজি প্রতি আরও যোগ হবে ৮ টাকা। সব মিলিয়ে দেখা গেছে এক কেজি আলু উৎপাদনে খরচ পড়ছে ২৬/২৮ টাকা। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতিকেজি আলুতে কৃষকদের লোকসান হচ্ছে ২০ থেকে ২২ টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে ১০/১২ টাকায় আলু বিক্রি হলেও পাইকারিতে দাম এর অর্ধেক।
জানা গেছে, কৃষি অফিসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ২০ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে এবার আলুর আবাদ হয়েছে। রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় এবার আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৬০২ হেক্টর জমিতে। সেখানে আবাদ হয়েছে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৩৯ হেক্টর। এবার আলুর উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২৬ টনের বেশি হয়েছে। এই পরিমাণ জমি থেকে প্রায় ৩২ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়েছে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী প্রতি মেট্রিকটন আলুতে ২০ হাজার টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। সেই হিসাবে ৩২ লাখ মেট্রিকটন আলুতে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে। এসব তথ্য জানা গেছে ব্যবসায়ী ও কৃষি অফিসের একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে।
রংপুর অঞ্চলের ৫ জেলায় ৭১টি হিমাগার রয়েছে। এসব হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা সাড়ে ৭ লাখ মেট্রিক টন। দুই একজন বড় কৃষক অথবা ব্যবসায়ী বাইরের জেলার হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করলেও হিমাগারের বাইরে রয়েছে ২২ থেকে ২৪ লাখ মেট্রিকটন আলু। এসব আলু কৃষকরা নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে থাকেন। তপ্ত আবহাওয়ায় সংরক্ষিত আলু নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় নামমাত্র মূল্যে কৃষকরা আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের নির্ধারিত মূল্য বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই