শনিবার, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা
দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল

বাংলাদেশি তরুণের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প

আবদুল কাদের

বাংলাদেশি তরুণের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প

হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে নেপালের পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে যাওয়া পথটিই ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’। যার দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। পৃথিবীতে মাত্র ৩২ জন অভিযাত্রী গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল অভিযান সফল করতে পেরেছেন। নেপালের পাহাড়ের উঁচু-নিচু দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অভিযান সফল করতে অনেক অভিযাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। এমন দুঃসাহসিক অভিযানে বাংলাদেশ থেকে একাই অংশ নিয়েছেন ইকরামুল হাসান শাকিল। আজ জানাব সেই দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প...

মহাকাশ, চূড়ান্ত সীমান্ত... যে কোনো অভিযাত্রীই জানবে স্টার ট্রেক টিভি সিরিজের এ লাইনটি। দীর্ঘ ১৪৮ দিনের বেশি সময়ে প্রায় ১৭৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া তেমনি একটি ট্রেইল। দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল। হিমালয়ের মধ্য দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পেরিয়ে যাওয়ার দুর্গম পাহাড়ি পথ। প্রায় ১০ ধরনের দুর্গম পথ পাড়ির মধ্য দিয়ে একজন পর্বতারোহীকে দ্য গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল শেষ করতে হয়। যার প্রতিটি দিন ও রাত কাটে অনিশ্চয়তা আর অজানা আতঙ্কে। পৃথিবীর ৩২ জন অভিযাত্রী এই গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছেন। একজন পর্বতারোহীর দৃষ্টিতে তারা এর মাধ্যমে অবশ্যই ভালো কিছু (অতিমানবীয় নয়) ক্ষমতার উপযুক্ত হন। ইকরামুল হাসান শাকিল; গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল অভিযানে অংশ নেওয়া বাংলাদেশি তরুণ। যিনি একা নির্জন ও দুর্গম এ পথ হেঁটেই পাড়ি দেওয়ার কঠিন অভিযানে নেমেছেন এখন থেকে প্রায় পাঁচ মাস আগে। এখন ভিসার মেয়াদ আর অর্থ ফুরিয়ে যাওয়ায় দুই-তৃতীয়াংশ পথ পাড়ি দিয়েই তাকে দেশে ফিরে আসতে হয়েছে। অর্থের সংস্থান হয়ে গেলেই আবার শুরু হবে অভিযান। পেরিয়ে আসা পথটা কেমন ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পৃথিবীর সব পর্বতারোহীর গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল একটি স্বপ্নের ট্রেইল। পরবর্তারোহী সবারই আকাক্সক্ষা থাকে জীবনে অন্তত একবার ‘গ্রেট হিমালয়ান ট্রেইল’ শেষ করা। বাংলাদেশ থেকে এর আগে কেউ ‘গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল’ অভিযানে অংশ নেননি। আমিই প্রথম। যদি ট্রেইলটি শেষ করতে পারি, তাহলে সেই অল্প মানুষের কাতারে থাকবে আমার নাম। থাকবে লাল-সবুজের বাংলাদেশের নাম- জানান এই তরুণ পর্বতারোহী। শাকিল ২০২২ সালে ২৮ জুলাই অভিযানে নামেন। পরের গল্পগুলো তার মতো করেই লেখা। ‘চার দিনের ট্র্যাকিং শেষে হিলসা বর্ডারে পৌঁছাই। এটি তিব্বত এবং নেপাল সীমান্ত এলাকা। আমার সঙ্গে একজন গাইড ছিল। যেহেতু নেপাল বর্ডার থেকে দোলপা পর্যন্ত তিনটি জেলা সম্পূর্ণ সংরক্ষিত, তাই এই আয়োজন। এখানকার নো ম্যানস ল্যান্ড থেকে অভিযান শুরু হয়। এখানে একবার আমি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। হিলসা থেকে রওনা করার সময়, আমার সঙ্গে একটা কুকুর এসেছিল। কুকুরটি সারা দিন আমার  সঙ্গেই ছিল। চলতি পথে খেয়াল করি কুকুরটি হঠাৎ সামনে গিয়ে থমকে গেছে। আর ওপরে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে কুকুরটি উপরে কিছু একটা লক্ষ্য করছে। কুকুরটির মতো আমিও উপরে তাকিয়ে দেখি বিশাল আকারের একটি পাথর নিচে নেমে আসছে। শুরু হয়ে গেল শিলাপ্রপাত। আমি দৌড়ে গিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে আসি। কুকুরটিও একই কাজ করল। তখনই মনে হলো- একটা কুকুরের মাধ্যমে আমি প্রথমবারের মতো বেঁচে ফিরলাম। প্রতিদিন মৃত্যুভয়, পথ হারানো আর নানা অনিশ্চয়তায় কাটতে শুরু করল। আট দিনের পথ পাড়ি দিয়ে চলে আসি রিভার ক্যাম্প। গা ছমছম করা জায়গা। একদম জঙ্গলের ভিতরে। সকাল সাড়ে ৬টায় হাঁটা শুরু করে শেষ হয় ঠিক সন্ধ্যায়। এর মাঝে কোনো গ্রাম কিংবা বসতি চোখে পড়েনি। তবে এখানে কাঠ চোরাকারবারিতে জড়িত ব্যক্তিদের একটি জায়গা চোখে পড়ে। সিদ্ধান্ত নিলাম এখানেই রাত কাটাব। যদিও রাতটা অনেকটা ভয়ে কেটেছিল। কারণ, কাঠ পাচারকারীরা আক্ষরিক অর্থে ভয়ানক। যদি ছিনতাই করে বসে! কারণ আমার সঙ্গে ছিল টাকা-পয়সা আর অনেকগুলো ডিভাইস। এখানেও ভাগ্য সায় দিয়েছে। এমনটা ঘটেনি। প্রতিদিনই ছিল কোনো না কোনো চ্যালেঞ্জ। উঁচু-নিচু পাহাড় পাড়ি দিতে হয়েছে। যেহেতু পাহাড়ি অঞ্চল, কোনো খরস্রোতা নদী নেই বললেই চলে। তাই ব্যাগপ্যাক নিয়ে ভিজে ভিজে অনেক পানিপথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আরেক দিনের ঘটনা- আমি ও আমার গাইড মাত্র মিনিটখানেকের ব্যবধানে ভূমিধসের কবল থেকে রক্ষা পাই। চলার পথে হঠাৎ খেয়াল করি, পেছনে মাটি ধসের বিকট শব্দ। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। মাত্র দুই মিনিট দেরি হলেই আমরা ভূমিধসে মারা পড়তাম। তাহলে আজকে আর গল্পটা বলা হতো না।’

সর্বশেষ খবর