ড. ফিজার আহম্মেদ। তিনি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার স্যায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। নওগাঁর ধামইরহাটের তালঝারী কৃষিখামারে যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন করছেন, তা অনন্য। প্রচলিত পদ্ধতিতে দেশে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি হলেও যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদনের ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক বিভাগ থেকে স্নাতক পাস করার পর ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করেন। পেয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্কলারশিপ। হ্যাঙ্গেরির করভেনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট থেকে বিজনেস ইনফরমেটিক্স বিষয়ের ওপর পিএইচডি করেন। ২০১৯ সালে বিদেশের চাকরি ছেড়ে দেশে আসার পর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনির্ভাসিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতে তৈরি সমন্বিত খামারে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। ২০০টি চেম্বার থেকে মাসে ১২০-১৩০ কেজি সার পান। এ ছাড়া খামারে সম্প্রতি স্থাপন করেছেন তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ শেড। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ওই শেডে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সারা বছর কেঁচো উৎপাদন করা হয়। ড. ফিজার আহেম্মদ বলেন, জার্মানির ইনোটেক-২১ কোম্পানিতে চাকরির সময় আমার দায়িত্ব পড়ে আফ্রিকার দেশসমূহে কৃষি প্রযুক্তিতে আইওটি যন্ত্রাংশের ব্যবহার নিশ্চিত করা। যেখানে কাজ করতে গিয়ে দেখি আফ্রিকার সাব সাহারান দেশের নিষ্ফলা মাটিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ফসল উৎপাদন বাড়িয়ে কীভাবে খাদ্য সংকট মোকাবিলা করছে। তখন আমার মনে হয়েছে, আফ্রিকার নিষ্ফলা মাটিতে যদি আইওটি যন্ত্রাংশের ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায়, তাহলে বাংলাদেশের মাটিতে আইওটির ব্যবহারে আরও বেশি সুফল পাওয়া যাবে। সেই চিন্তা থেকে দেশে একটা আধুনিক খামার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব খামার তৈরির স্বপ্ন দেখি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে অর্থসহায়তা করেছে। এ ছাড়া জ্বালানি মন্ত্রণালয় টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হাউসহোল্ড এনার্জি প্রোডাকশন প্রকল্পের অধীনে অর্থসহায়তা করেছে। জার্মানির কোম্পানিতে কাজ করা অবস্থায় বিদেশ থেকে নির্দেশনা দিয়ে ২০১৭ সালে গ্রামের বাড়িতে নিজের ৬ বিঘা জমিতে দুটি শেড তৈরি করে প্রথমে কিছু গরু ও ছাগল কিনে লালন-পালন শুরু করি। খামারের গরু ও ছাগল থেকে পাওয়া গোবর ও মূত্র থেকে প্রচলিত পদ্ধতিতে স্বল্প পরিসরে কেঁচো সার উৎপাদন করা হতো। এরপর দেশে আসার পর খামারসংলগ্ন আরও ৬ বিঘা জমি লিজ নিয়ে সেটাতে পুকুর খনন করে মাছ ও হাঁস পালনের পাশাপাশি সম্পূর্ণ যান্ত্রিক পদ্ধতিতে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে বিদ্যুৎ ও কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করি। যান্ত্রিক কলাকৌশল ব্যবহার করায় প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট সময়ে দ্বিগুণ সার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে। ১২ জন কর্মচারী ও ম্যানেজারের বেতন বাদে লালন-পালন করা গবাদিপশু ও পুকুরের মাছ বিক্রি করে বছরে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা আয় হয়।
এ ছাড়া সার বিক্রি করে ১২-১৩ লাখ টাকা আয় হয়। খামারে উৎপাদিত কেঁচো সার অফলাইনের পাশাপাশি অনলাইনে সফটওয়্যার ফেসবুক পেজের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। ড. ফিজার জানান, বর্তমানে খামারে ১৬টি গরু, ৪০টি ছাগল এবং ৮০০টি হাঁস রয়েছে। খামারের প্রতিদিনের বর্জ্য থেকে ৫ কি.ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এ ছাড়া বায়োগ্যাস প্লান্ট থেকে পাওয়া তরল বর্জ্য মেশিনের সাহায্যে পানি ছাড়িয়ে সলিডকে নেওয়া হচ্ছে ভার্মি কম্পোস্ট শেডে। যেখানে তৈরি হচ্ছে মাটির জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভার্মি কম্পোস্ট। প্রতিদিন গড়ে এক টন করে কেঁচো সার পান। মাসে প্রায় ৩০ টন সার উৎপাদন হয়। মাসে দেড় লাখ টাকার অধিক কেঁচো সার বিক্রি হয়। ধামইরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তৌফিক আল জোবায়ের ও প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা জাহিদুর রহমান বলেন, তালঝারী কৃষিখামারে যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তির ব্যবহার করে যে পদ্ধতিতে কেঁচো সার উৎপাদন করা হচ্ছে তা অনন্য। প্রচলিত ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশে ভার্মি কম্পোস্ট সার তৈরি হয়ে আসছে। কিন্তু যান্ত্রিক কলাকৌশল ও আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো সার উৎপাদন করে নজর কেড়েছেন ড. ফিজার আহম্মেদ।