সোমবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

রেকর্ডবুকে স্পিন ফাঁদের মিরপুর

মেজবাহ্-উল-হক

রেকর্ডবুকে স্পিন ফাঁদের মিরপুর

পাঁচ দিনের টেস্ট। অথচ তিন দিনেই ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংসে হারিয়ে বাংলাদেশ ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতল। জয়ের পর ট্রফি হাতে উল্লসিত ক্রিকেটাররা —রোহেত রাজীব

সকালে একাডেমি মাঠে পেস বোলারদের নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন কোর্টনি ওয়ালশ। পাশেই স্টেডিয়ামে সাকিব-মিরাজ-তাইজুল ঘূর্ণি জাদু দেখিয়ে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়ছেন তখন চোয়াল শক্ত করে মুস্তাফিজ-খালেদদের তালিম দিচ্ছিলেন উইন্ডিজ কিংবদন্তি। ঘন ঘন উইকেট পতনে হাজার কয়েক দর্শকের গর্জন যখন শেরেবাংলা স্টেডিয়াম প্রকম্পিত হচ্ছিল, সেই আওয়াজ কি ওয়ালশের বুকে কাঁটার মতো বিঁধছিল! হয়তো উইন্ডিজ কিংবদন্তির জেদও বাড়িয়ে দিচ্ছিল! টেস্টের ইতিহাসে ওয়ালশই প্রথম তিন শতাধিক উইকেট শিকারের অনন্য রেকর্ডের অধিকারী, যার সামনে পড়লে তারকা ব্যাটসম্যানদেরও হাত-পা কাঁপতে শুরু করে দিত।  সেই ওয়ালশ বাংলাদেশ দলের পেস বোলিং উপদেষ্টা অথচ ঢাকা টেস্টে একাদশে কোনো পেসারের জায়গাই হয়নি। এই টেস্টে পেসার ছাড়া একাদশ দেখে অনেকেই সমালোচনা করেছিলেন। হয়তো বিরক্ত হয়েছিলেন স্বয়ং ওয়ালশও, পেসার ছাড়া আবার দল হয় নাকি? কিন্তু শুধুমাত্র স্পিনারদের কাঁধে ভর করেই তো গতকাল মিরপুরে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে ইনিংস ও ১৮৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। টেস্টের ইতিহাসে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। ২০০০ সালে বাংলাদেশের টেস্ট আঙিনায় যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম ইনিংস ব্যবধানে জিতলো টাইগাররা। এই টেস্টের ২০ উইকেটই নিয়েছেন স্পিনাররা (পেসার নেই, রান আউটও হয়নি)।

‘হোম অব ক্রিকেট’ মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের পঞ্চম টেস্ট জয়। অবশ্য এই পাঁচ জয়েই একাধিপত্য ছিল স্পিনারদের। জয় পাওয়া এই ৫ ম্যাচে প্রতিপক্ষের ১০০ উইকেটের মধ্যে ৯২টি উইকেটই নিয়েছেন বাংলাদেশের স্পিনাররা। পেসারদের ঝুলিতে গেছে মাত্র ৪ উইকেট। এছাড়া দুটি রান আউট ও দুই ব্যাটসম্যান ইনজুরির কারণে অনুপস্থিত ছিলেন। স্পিনাররা বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন মিরপুর তাদের জন্য স্বর্গ। এই মিরপুরে আগের চার জয়ে তবু একজন কিংবা দুজন করে পেসার ছিল। আর এবার ইতিহাস গড়ে ইনিংস ব্যবধানে জিতে সাকিবরা যেন পেসার না নেওয়ার সিদ্ধান্তের যথার্থতাও প্রমাণ করে দিলেন। বিশ্বের আর কোনো স্টেডিয়ামে স্বাগতিক দলের সব জয়ে স্পিনারদের এমন দাপট আর নেই। সে দিক দিয়ে মিরপুরও যেন রেকর্ডবুকে আলাদা জায়গা করে নিল। শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জিতেছিল ২০১৪ সালের অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে, ৩ উইকেটে। ওই ম্যাচে সাকিব, তাইজুল ও জুবায়ের লিখন মিলে নিয়েছিলেন ১৮ উইকেট। মাত্র দুই উইকেট নিয়েছিলেন পেসার শাহাদত। দ্বিতীয় জয়টি ২০১৬ সালের অক্টোবরে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, ১০৮ রানে। যে ম্যাচে ২০ উইকেটই শিকার করেছিলেন স্পিনাররা। মিরাজের ১২ উইকেট, সাকিব ৫টি এবং ৩ উইকেট নিয়েছিলেন তাইজুল। ২০১৭ সালের আগস্টে এই মাঠে অস্ট্রেলিয়ার মতো ক্রিকেট শক্তিকে নাস্তানাবুদ করে বাংলাদেশ। ২০ রানের ঐতিহাসিক এক জয়। ওই ম্যাচে ১৯ উইকেটই নিয়েছেন স্পিনাররা। প্রতিপক্ষের এক ব্যাটসম্যান হয়েছেন রান আউটের শিকার। সাকিব ১০, মিরাজ ৫ এবং ৪ উইকেট নিয়েছিলেন তাইজুল। এর আগের সিরিজে গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের ২১৮ রানের আরেকটি বিশাল জয়। ওই ম্যাচে ইনজুরির কারণে সাকিব ছিলেন না। মেহেদী হাসান মিরাজ (৮) ও তাইজুল (৭) মিলে নিয়েছেন ১৫ উইকেট। এছাড়া দুই উইকেট পেয়েছেন পেসাররা, একটি রান আউট এবং ইনজুরির কারণে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যান চাতারা দুই ইনিংসে ব্যাট করতে পারেননি।

আর বাংলাদেশের স্পিনারদের মধ্যে উইকেট শিকারে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ৯২ উইকেটের মধ্যে তার ঝুলিতে জমা হয়েছে ৩৭টি। যদিও জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে প্রথম জয়ে ছিলেন না খুলনার এই তারকা স্পিনার। মিরপুরে পাওয়া ৫ টেস্ট জয়েই সঙ্গী তাইজুল। তিনি নিয়েছেন ২৭ উইকেট। ইনজুরির কারণে জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে সিরিজে খেলতে পারেনি। চার ম্যাচে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার নিয়েছেন ২৬ উইকেট। বাকি ৩ উইকেটের মধ্যে দুটি উইকেট লেগ স্পিনার জুবায়েরের এবং একটি নিয়েছেন নাঈম হাসান।

কালকের এই স্মরণীয় জয়েও উইকেট শিকারে নেতৃত্ব দিয়েছেন মেহেদী হাসান মিরাজ। ১১৭ রানে ১২ উইকেট নিয়ে ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করেছেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসেই সেরা বোলিং ফিগার। এর আগের রেকর্ডও ছিল তারই। কেবল নিজের রেকর্ড ভেঙে নতুন করে গড়লেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে দুই টেস্টের সিরিজে মিরাজের ঝুলিতে জমা হয়েছে মোট ১৮ উইকেট। আর ব্যাটে বলে দুর্দান্ত দাপট দেখিয়ে সিরিজ সেরা হয়েছেন সাকিব। দুই ম্যাচের এই সিরিজে ৪০ উইকেটই নিয়েছেন স্পিনাররা। এটিও তো টেস্টের ইতিহাসে বিশ্বরেকর্ড। ২০০৯ সালে প্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্টে হোয়াইটওয়াশ করেছিল বাংলাদেশ। কাকতালীয়ভাবে সেই টেস্ট সিরিজ দিয়েই অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হয়েছিল সাকিব আল হাসানের। আর সেই ক্যারিবীয়দের বিরুদ্ধে সেই সাকিবের নেতৃত্বেই ২-০ ব্যবধানে সিরিজ জিতে দ্বিতীয়বারের মতো হোয়াইটওয়াশ করার মধুর স্বাদ নিল বাংলাদেশ। ১০ বছর আগের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল এক ‘দুর্বল’ দল। বোর্ডের সঙ্গে দ্বন্দ্ব্বের কারণে তখন নিয়মিত ক্রিকেটারের অনেকে ছিলেন না। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলল তাদের সেরা দল নিয়ে। যে দলটি কয়েক মাস আগেই তাদের ঘরের মাঠে এই বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করে এবং র‌্যাঙ্কিংয়েও এক ধাপ নামিয়ে দিয়েছিল, এবার বিরুদ্ধে একইভাবে সিরিজ জিতে র‌্যাঙ্কিংয়ে উপরে ওঠে মধুর এক প্রতিশোধ নিল বাংলাদেশ। সে কারণেই সিরিজ জয়কে সবচেয়ে জয় বলে মনে করছেন সাকিব, ‘২০০৯ সালের জয়টা ছিল আমাদের ক্রিকেটের জন্য টার্নিং পয়েন্ট। আর এই জয়ে মনে হচ্ছে, আমরা আরও বড় দলে পরিণত হচ্ছি। একেই এগিয়ে রাখবো।’ আর এগিয়ে না রেখে উপায় আছে, এ যে বিজয়ের মাসে ক্রিকেটের মহা বিজয়!

সংক্ষিপ্ত স্কোর

বাংলাদেশ : ৫০৮/১০, ওয়েস্টইন্ডিজ : ১১১/১০, ২১৩/১০

সর্বশেষ খবর