ক্রিকেট, ফুটবল ও হকি দেশের বড় তিন ফেডারেশন বলেই কর্মকর্তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘিরে বেশি আলোচনা হচ্ছে। বাস্তবে কিন্তু সব ফেডারেশনের একই চিত্র। দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে ক্রীড়াঙ্গন। বড় তিন ফেডারেশনে একাধিক সদস্য নিয়ে কমিটি গঠন করা হলেও অভিযোগ আছে কাউকে নাকি কাজই করতে দেওয়া হতো না। ক্রিকেট বোর্ড ২৫ সদস্য পরিচালক, বাফুফেতে ২১ ও হকিতে ৩১ জন নিয়ে নির্বাহী কমিটি গঠিত। লম্বা কমিটি হলেও তিন ফেডারেশনের কর্মকান্ড নাকি দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। যাকে বলা হয় ‘জুটি’। ক্রিকেট বোর্ডে সবাইকে পাশ কাটিয়ে সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের মূল সঙ্গী ছিলেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক। কখনো ক্রীড়াঙ্গনে দেখা না গেলেও পাপন সভাপতি হওয়ার পরই বিসিবির পরিচালক হন তিনি। পাপন ছিলেন বেক্সিমকোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মল্লিকও একই কোম্পানিতে চাকরি করতেন। অনেকে তাকে পাপনের পিএস বলেন।
সেই মল্লিকই হয়ে ওঠেন ক্রিকেটে দাপুটে কর্মকর্তা। সত্যি বলতে, তার ভয়ে অন্য পরিচালকরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে সাহস পেতেন না। অনেকে বলেন, ক্রিকেটের ফান্ড দিয়ে দেশের অন্য ফেডারেশনও চালানো যায়। কোটি কোটি টাকার কথা শোনা গেলেও প্রকৃতপক্ষে বিসিবি কখনো প্রকাশ করেনি তাদের ফান্ডে কত টাকা রয়েছে। পাপন যদিও আওয়ামী সরকারের শেষ আমলে ক্রীড়ামন্ত্রী হন। তার আগেও ছিলেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর চেয়েও প্রভাবশালী। ক্রিকেটের কোনো বিষয়ে এক শেখ হাসিনা ছাড়া কাউকে কোনো কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করতেন না।
সভাপতি পদ ধরে রাখতে পাপন ব্যবহার করেন মল্লিককে। অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে নিজেরা বেশকটি ক্লাব পরিচালনা করেন। যাতে নিজেদের কাউন্সিলরশিপ বাড়ানো যায়। এমন কোনো অনিয়ম নেই আওয়ামী লীগ আমলে বিসিবিতে হয়নি। আর তা করেছেন পাপন ও মল্লিক জুটি। এতদিন শুধু ফুটবলেই অর্থ লোপাটের কথা শোনা গেছে। ক্রিকেটে নাকি সমুদ্র চুরি হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে পাপন-মল্লিক জুটির মাধ্যমে। অন্য পরিচালকরা ধোয়া তুলসীপাতা তাও বলা যাবে না। অনিয়ম তো করেছেনই, সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলে বাঁকা পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে টাকার পাহাড় গড়েন। এখানে আবার চাটুকারেও অভাব নেই। বিশেষ করে একটি পেশার লোকেরা পাপনের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিয়েও এখন দেখা যাচ্ছে তারা রূপ পাল্টে ফেলেছেন।
ফুটবলে কাজী সালাউদ্দিন ও মাহফুজা আক্তার কিরণের জুটি ছিল সবচেয়ে আলোচিত। সালাউদ্দিন না হয় দেশের সুপারস্টার ছিলেন। কিন্তু কিরণ এত প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন কীভাবে সেটাই প্রশ্ন। যোগ্য লোকদের টপকিয়ে ২০০৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে কিরণ হয়ে যান বাংলাদেশের দলনেতা। তার ভিতর এমন কী জাদু আছে যা দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। ২০০৮ সাল থেকেই সালাউদ্দিন বাফুফের সভাপতি। বাদল রায়, সালাম মুর্শেদী, শেখ মো. আসলাম ছাড়া আরও তারকা ফুটবলার কমিটিতে ছিলেন। অনেকের ধারণা ছিল- যোগ্য ফুটবলার যখন আছেন তখন ফুটবলের উন্নয়ন ঘটবেই। কিন্তু তা আর হয়নি, কেউ কেউ অভিমানে দূরে সরে যান। আর এসব নাকি হয়েছে কিরণের কারণে। এত বড় বড় খেলোয়াড় থাকার পরও সালাউদ্দিন নাকি বিশ্বাস করতেন কিরণকেই। বাদল রায়ের পদত্যাগের পেছনেও কিরণের নাকি হাত ছিল। ফুটবলের যে করুণ হাল তাতে অনেকে সালাউদ্দিন-কিরণ জুটিকেই দায়ী করেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, অর্থ লোপাটে ফুটবলের মান শূন্যতে নেমে গেছে। হাহাকার ছাড়া কিছুই নেই। কিরণ সার্বক্ষণিক সালাউদ্দিনের পাশে থাকায় এ নিয়ে বিতর্কের শেষ ছিল না।
আসা যাক হকির মুমিনুল হক সাঈদের প্রসঙ্গে। একসময়ে তিনি নাকি মোহামেডান ক্লাবে হাউজির সিট বিক্রি করতেন। মতিঝিলে চোরা পেট্রোল বিক্রি করতে দেখা গেছে তাকে। যোগ্য ও অভিজ্ঞ সংগঠকদের বিতাড়িত করে তিনিই হয়ে যান দেশের তৃতীয় জনপ্রিয় খেলা হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক। যোগ্যতা বা হকি সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না থাকলেও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে বসেন। তাকে বড় সহযোগিতা করেন হকির পরিচিত মুখ রশিদ শিকদার। দুজনকে বলা হয় হকির আলোচিত জুটি। এমন কোনো কুকর্ম নেই যে তারা হকিতে করেননি। সাধারণ সম্পাদক সাঈদ ও সহসভাপতি রশিদ দুজনই এখন পলাতক। ক্রীড়ামোদীদের দাবি, অনিয়ম দূর করতে সর্বত্র যেমন দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে, তেমনি তিন ফেডারেশনের আলোচিত জুটিদের কর্মকান্ড তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।