স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের শুরুতে ক্রিকেটের পরিচর্যা যেভাবে করার কথা ছিল, সেখানে হয়েছে উল্টোটা। স্বাধীনতার পর শুরুতে অবহেলিত হয়েছে ক্রিকেট খেলা। আশ্চর্য হলেও সত্য, ঢাকা ক্রিকেট লিগের প্রথম আসর সফলভাবে সম্পন্ন করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে চার বছরেরও বেশি সময়। পাকিস্তান আমলে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে ৭টি টেস্ট অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ অঞ্চলে ক্রিকেট চর্চা, ক্রিকেটের প্রতি অন্য এক ভালোলাগা, ভালোবাসা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ক্রিকেট। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর সেই খেলাটিকেই চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দীন আহমদ এক সভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন- ‘বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে ক্রিকেট খেলা বিলাসিতা। এই খেলা আমাদের বর্জন করাই শ্রেয়। বাংলাদেশের মাটিতে বুর্জোয়াদের ক্রিকেটে কোনো স্থান নেই ’ (হাসান বাবলী রচিত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ)। তার এ বক্তব্যে ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন ক্রিকেটাররা। পল্টন ময়দানে সমবেত হয়ে ব্যাট-প্যাড, স্ট্যাম্পে আগুন জ্বালিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সে সময়ের নামকরা ক্রিকেটাররা। শুধু ক্রিকেটবিরোধী বক্তব্যই দেননি সে সময়ের অর্থমন্ত্রী, ক্রিকেটের ওপর অধিকমাত্রায় ট্যাক্স আরোপ করে এ খেলাটির ভবিষ্যৎ উৎকণ্ঠায় ফেলার মতো পরিস্থিতিও তৈরি করা হয়েছে তখন।
সত্যি বলতে কি, ক্রিকেটকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করার পক্ষে ছিল না সে সময়ের সরকার। ফলে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত এ খেলাটি সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি। শৌখিন মডেলে দেশের মধ্যে রুটিন কটি ঘরোয়া আসরে এই খেলাটি ছিল সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ নামে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় হয়েছে বলে আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ না থাকায় টেস্ট ক্রিকেট দূরে থাক, প্রথম শ্রেণির ম্যাচের মর্যাদা ছিল না তখন। জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচগুলো তিন দিন এবং চার দিনের হলেও সেই ম্যাচগুলো গণ্য হয়নি তখন প্রথম শ্রেণির ম্যাচে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে হলে আইসিসির সদস্যপদ পেতে হবে- এ ধারণাটাই ছিল না তখন এ দেশের ক্রিকেট কর্তাদের! আশ্চর্য হলেও সত্য, তৎকালীন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) এবং জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের (এনএসসিবি) কেউ ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)-এর কাছে বাংলাদেশের সদস্যপদের জন্য আবেদনই করেননি!
১৯৭৩ সালে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল ৫ ম্যাচের টেস্ট খেলতে ভারত সফরে এসেছে। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের সঙ্গে ভারতে এসেছিলেন সাবেক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার এবং সানডে টাইমসের সে সময়ের বিশেষ সংবাদদাতা রবিন মার্লার। কলকাতা টেস্টের পর চেন্নাই টেস্টের আগে ৯ দিনের একটা লম্বা গ্যাপ ছিল। সেই বিরতির সময়ে ঢাকায় এসেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর এ দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু অনুসন্ধানীমূলক রিপোর্ট করতে।
ঢাকায় এসে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুঁ মেরেছিলেন তিনি। সেখানে বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক কামরুজ্জামান ভাইয়ের (দৈনিক বাংলার তৎকালীন ক্রীড়া সম্পাদক) সঙ্গে ওনার দেখা হয়। কৌতূহল নিয়ে জামান ভাইয়ের সঙ্গে তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম (বর্তমানে ঢাকা জাতীয় স্টেডিয়াম) ঘুরে দেখেছেন। ঢাকা স্টেডিয়ামে পা রেখেই তিনি অবাক। পাকিস্তান আমলে যে মাঠে হয়েছে টেস্ট ক্রিকেট, ১৯৫৫ সালে যে স্টেডিয়ামের টেস্ট অভিষেক হয়েছে, সেই মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো দূরের কথা, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও হচ্ছে না! হচ্ছে ফুটবল খেলা। বিষয়টি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করে বেশ কিছুদিন পর ‘উইদার বাংলাদেশ ক্রিকেট’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। যা প্রকাশিত হয়েছিল সানডে টাইমসে গুরুত্ব সহকারে। এ দেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর শহীদ জিয়া যখন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন, তখন ক্রিকেট নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকে। রাজনৈতিক পরিচয় নয়, ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে অতীত অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা মুখ্য-এই দর্শনে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের কার্যনির্বাহী কমিটিতে এলো পরিবর্তন। পরীক্ষিত ক্রিকেট সংগঠকরা বিসিসিবিতে জায়গা পেলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে এ অঞ্চলের ক্রিকেট পরিচালনায় ইস্ট পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের (ইপিএসএফ) ক্রিকেট কমিটির সেক্রেটারির ভূমিকায় প্রশংসিত ছিলেন সাবেক প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার রাইসউদ্দিন আহমেদ। ১৯৭৬ সালে পুনর্গঠিত বিসিসিবিতে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাকে নিযুক্ত করা হয়।
লন্ডনে সে সময়ে উচ্চশিক্ষায় অবস্থানরত ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক (পরবর্তীতে জাতীয় ক্রিকেটার, বিসিবির সাধারণ সম্পাদক, এসিসির সিইও) রবিন মার্লারের ওই লেখাটি নিয়ে যোগাযোগ করেন বিসিসিবির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রাইসউদ্দিন আহমেদ এবং যুগ্ম-সম্পাদক রেজা-ই-করিমের সঙ্গে (করোনাকালে এই দুই পরীক্ষিত ক্রিকেট সংগঠক ইন্তেকাল করেছেন)। পরবর্তীতে রবিন মার্লারের পরামর্শে এই দুজন বিসিসিবির গঠনতন্ত্র ইংরেজিতে অনুবাদ করে পাঠিয়ে দেন আইসিসিতে। গঠনতন্ত্রের সঙ্গে বাংলাদেশকে আইসিসির সদস্যপদ দেওয়া হোক, এই চিঠিও দেওয়া হয় আইসিসিতে।
তখন ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের অফিস ছিল ইংল্যান্ডের লর্ডসে। লর্ডসের মালিক মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি)। এই এমসিসিই ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা। আইসিসিতে তাদের প্রভাব যথেষ্ট। আইসিসিতে তাদের সুপারিশই যথেষ্ট। আইসিসির সদস্যপদের দাবি তুলতে হলে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানাতে হবে এমসিসিকে-এই কৌশলটা বলে দিয়েছিলেন রবিন মার্লার। তার পরামর্শ অনুযায়ী ১৯৭৬ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফরে এমসিসিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ আমন্ত্রণ পেয়ে সে বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সফরে সম্মতি দেয় এমসিসি।
ইংল্যান্ড থেকে এমসিসিকে ঢাকায় আনা, বাংলাদেশ সফরে আকাশপথে রাজশাহী-চট্টগ্রাম-যশোরে যাতায়াতও ব্যয়বহুল। আন্তর্জাতিক হোটেলে দিতে হবে সফরকারী দলটিকে আবাসন সুবিধা-এসব ব্যয় বিসিসিবির পক্ষ থেকে নির্বাহ করা মোটেও সহজ ছিল না। শহীদ জিয়াউর রহমান সরকারের নির্দেশনায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস অতিথি দলের ভ্রমণ সুবিধা দিতে রাজি হলে বিসিসিবির দুশ্চিন্তা কেটে যায়। বড় খরচ থেকে বেঁচে যায় বিসিসিবি। ১৯৭৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজশাহীতে জোনাল ম্যাচের মধ্য দিয়ে টেড ক্লার্কের নেতৃত্বে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম কোনো বিদেশি দলের সঙ্গে স্থানীয় ক্রিকেট দলের খেলা দেখে দর্শক।
১৯৭৭ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঐতিহাসিক দিন। ওই দিনেই শামীম কবিরের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ দলের পথচলা শুরু। ১৮৭৭ সালে টেস্ট প্রবর্তনের এক শতাব্দী পালনের বছরে শুরু হলো বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের পথচলা। ১৭৮৮ সাল থেকে ক্রিকেটের আইনপ্রণেতা এমসিসি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত এমসিসির ব্যানারেই ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল করত দ্বিপক্ষীয় সফর। ক্রিকেটের সবচেয়ে অভিজাত এই ক্লাবকেই আনা হলো বাংলাদেশ সফরে।
সকালে ঢাকা স্টেডিয়ামে এসে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলার শুরুটা সংক্ষিপ্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করেছেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। পরিচিত হয়েছেন দুই দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে। কথা বলেছেন তিন দিনের বেসরকারি টেস্ট ম্যাচের দুই আম্পায়ার এবং অফিশিয়ালদের সঙ্গে। অতিথি দলকে সর্বোচ্চ আতিথেয়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টদের। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলায় বাংলাদেশ দলের জন্য শুভকামনা করেছেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে দুই দলের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নিয়ে ইতিহাস হয়ে গেছেন বাংলাদেশের মাটিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রবর্তক।
বাংলাদেশের মানুষের ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা, আবেগ এবং আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধতার কথা ওই সফরকালে গণমাধ্যমকে অসংখ্যবার বলেছেন টেড ক্লার্কের নেতৃত্বাধীন দলের মুখপাত্ররা। বাংলাদেশ আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পাচ্ছে- সফর শেষে দেশে ফেরার প্রাক্কালে তৎকালীন বিসিসিবির কর্তাদের এমসিসি দিয়েছিল এই আভাস। তাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই আইসিসির বার্ষিক সাধারণ সভায় বাংলাদেশকে দেওয়া হয় সহযোগী সদস্যপদ। ওই সভায় একটি মাত্র এজেন্ডা ছিল, তা ছিল বাংলাদেশের সহযোগী সদস্যপদ ইস্যু। ওই এজেন্ডা ওঠা মাত্রই তা পাস হয়ে যায়। ফলে জাতীয় দলের ব্যানারে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার অনুমতি পায় বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে ইংল্যান্ডে প্রথমবারের মতো প্রতর্বিত আইসিসি ট্রফির অভিষেক আসরে অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের যোগ্যতা নির্ধারণী আসর আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় বাংলাদেশের। সৈয়দ আশরাফুল হকের ভয়ংকর বোলিংয়ে (৭/২২) ফিজির বিপক্ষে জয় দিয়ে অভিষেক ম্যাচ উদ্যাপন করে বাংলাদেশ দল। বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিলের সহযোগী সদস্যপদ পাওয়ায় আইসিসি ট্রফিতে নিয়মিত অংশগ্রহণের সুযোগ পায় বাংলাদেশ।
এমসিসির বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের পথচলা শুরু। তাদের সুপারিশে ১৯৭৭ সালে আইসিসির সহযোগী সদস্যপদ পেয়েছে বাংলাদেশ। পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ পেয়েছে আইসিসির ওয়ানডে মর্যাদা। ২০০০ সালে পেয়েছে টেস্ট মর্যাদা। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ এখন ক্রিকেটে পরাশক্তির কাতারে উঠে এসেছে। ক্রিকেটকে ঘিরে বাংলাদেশের মানুষ দেখছে স্বপ্ন। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এ পর্যায়ে আনার পেছনে যাদের নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হবে, তাঁদের সর্বাগ্রে রাখতে হবে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং তাঁর শাসনকালে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দক্ষ কর্মকর্তাদের।
লেখক : হেড অব রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বসুন্ধরা গ্রুপ