জার্মান ভাষায় 'ডার কাইসার'। অর্থ সম্রাট কিংবা রাজা। ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে জার্মানরা এই নামেই ডাকে। কেবল জার্মানরা কেন, বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ফুটবলভক্তদের সবাই তাকে একজন সম্রাট হিসেবেই জানে। তার দখলে এমন এক রেকর্ড রয়েছে, যার স্পর্শ পাননি ফুটবলের বড় বড় কিংবদন্তিরাও। একজন অধিনায়ক হিসেবে ১৯৭৪ সালে বিশ্বকাপ জয় করেন বেকেনবাওয়ার। ১৯৯০ সালে জয় করেন কোচ হিসেবে। এই কৃতিত্ব কেবল তারই। অবশ্য ব্রাজিলিয়ান মারিও জাগালো ফুটবলার ও কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করেছিলেন আরও আগেই।
মারিও জাগালো ১৯৫৮ সালে একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার হিসেবে বিশ্বকাপের সোনার ট্রফিতে চুমু খেয়েছিলেন। ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ার তখন ১৩ বছরের বালক। জাগালো ১৯৬২ বিশ্বকাপও জয় করেছেন পেলেদের সঙ্গী হিসেবে। এরপরই তার ভূমিকায় ভিন্নতা আসে। ১৯৭০ সালে পেলেদের গুরুর ভূমিকায় ছিলেন মারিও জাগালো। ফুটবলার এবং কোচ উভয় ভূমিকায় বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব কেবল মারিও জাগালোরই ছিল। তবে বেকেনবাওয়ার এই রেকর্ডে বাড়তি কিছু বিষয় যোগ করেন ১৯৭৪ ও ১৯৯০ সালে। অধিনায়ক এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব গড়েন এই জার্মান তারকা। ১৯৭৪ সালে গার্ড মুলারদের দলপতি ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৯০ সালে লোথার ম্যাথুসদের কোচ হিসেবে জয় করেন বিশ্বকাপ শিরোপা।
সর্বকালের সেরা জার্মান ফুটবলার। পেলে-ম্যারাডোনাদের সারিতে যে কজন ফুটবলারকে স্থান দেওয়া যায় তাদের মধ্যে অন্যতম তিনি। যদিও তার পজিশন ছিল পেলে-ম্যারাডোনার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রান্তে। একজন 'সুইপারে'র দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। ১৯৯০ পর্যন্তও এই টার্মটা ফুটবলে বহুল পরিচিত ছিল। সুইপাররা কেবল ডিফেন্সেই দায়িত্ব পালন করেন না, প্রায়ই আক্রমণভাগেও থাকে তাদের সরব উপস্থিতি। বর্তমানে এই ভূমিকায় সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বার্সেলোনার ব্রাজিলিয়ান তারকা দানি আলভেসকে। ফ্র্যাঞ্জ বেকেনবাওয়ার পশ্চিম জার্মানির রক্ষণভাগে যেমন অজেয় দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন তেমনই গার্ড মুলারদের সঙ্গ দিয়েছেন নিয়মিত। ১০৩ ম্যাচে তার ১৪ টা দুর্দান্ত গোলও রয়েছে।
একজন মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বেকেনবাওয়ার। তবে কালক্রমে তিনিই হয়ে উঠেন জার্মান ডিফেন্সের প্রধান রক্ষক। বেকেনবাওয়ার ১৯৬৬ সালে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিলেন। সেবার ববি মুরদের দাপটের কাছে হার মেনেছিল ফুটবলবিশ্ব। এরপর ১৯৭০ সালে ফিরে এসেছিল ব্রাজিলের সাম্বা ছন্দ। তবে ১৯৭৪ সালে জার্মানরা বেকেনবাওয়ারের নেতৃত্বে ফুটবলকে সংজ্ঞায়িত করেছিল নতুন করে। ইয়োহান ক্রুইফের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করেছিল সেদিন জার্মানরা। ১৯৯০ সালে আরও একবার দেখা গিয়েছিল বেকেনবাওয়ারের জাদু। কেবল ফুটবলার হিসেবেই নয় বেকেনবাওয়ার কোচের ভূমিকায়ও উতরে গেলেন দারুণভাবেই। দিয়েগো ম্যারাডোনার দুর্দান্ত আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে লোথার ম্যাথুসদের নিয়ে জয় করলেন জার্মানির তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা। আরও একটি রেকর্ড গড়ার সুযোগ ছিল বেকেনবাওয়ারের সামনে। ২০০৬ বিশ্বকাপটা জয় করতে পারলেই তিনি হয়ে উঠতেন অস্পৃশ্য। অধিনায়ক, কোচ এবং আয়োজক হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের একমাত্র কৃতিত্ব থাকত তার। নিজেদের দেশের সেই বিশ্বকাপে কেবল সেমিফাইনালই খেলার সুযোগ পেয়েছিল জার্মানরা। আয়োজক হিসেবে জিততে না পারলেও বেকেনবাওয়ার আছেন একক উচ্চতায়। এখনো অধিনায়ক এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের কৃতিত্ব গড়তে পারেননি কেউই। এ সুযোগ পেয়েছিলেন ডুঙ্গা এবং ম্যারাডোনা। দুজনেই ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে চলে গেছেন।