এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় অনেকগুলো বাঁক পেরোনোর পর 'নতুন দালান' উঠা একটা বাড়ি নজরে পড়ল। মোটরসাইকেলের চালক জানালেন, এটাই 'স্কুটার' গফুরের বাড়ি। নরসিংদী জেলার চিনিশপুর ইউনিয়নের এক গ্রাম। এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন স্বাধীনতার আগে এবং পরের কিংবদন্তিতুল্য ফুটবলার 'স্কুটার' গফুর। লেফট উইংয়ের গোড়া থেকে বল নিয়ে এত দ্রুত গতিতে ছুটে চলতেন ছোটখাট দেখতে এ ফুটবলার তার উপনাম হয়ে পড়েছিল 'স্কুটার'। এক সময় ঢাকার রাস্তায় স্কুটারই ছিল সবচেয়ে দ্রুতগতির যানবাহন। উপাধিটা পাকিস্তান আমলের। সেই স্কুটার গফুর এখন জীবন সায়াহ্নে। বার বার স্ট্রোক করার কারণে ফুটবল ক্যারিয়ারের অনেক স্মৃতিই হারিয়ে গেছে অতীতের গর্ভে। তারপরও ভাসা ভাসা অনেক কিছু বললেন তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে। ফুটবলের সোনালি অতীতের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বার বার আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছেন। কখনো নিজের ফুটবল ক্যারিয়ারের কথা স্মরণ করে অশ্রুসিক্ত হয়েছে তার চোখ।
চোখে অনেক কম দেখতে পান। শ্রবণ শক্তিতেও ভাটা পড়েছে। বয়স জানতে চাইলে পাশে থাকা ভাগ্নে জসিম উদ্দিন জানালেন, ৭৫ বছর হবে হয়ত। 'স্কুটার' গফুর পেশাদার ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন ১৯৬৪ সালে বিজিপ্রেসে। দুই বছর খেলেছেন এখানে। এরপর টানা ছয় বছর খেলেছেন রহমতগঞ্জে। স্বাধীনতার পর খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। তবে মন্টু কায়সার তাকে বাড়ি থেকে এক রকম জোর করেই ধরে এনেছিলেন নতুন গড়া দল আবাহনীতে খেলানোর জন্য। ১৯৭২ সালে আবাহনীতে যুগ দেন গফুর। ১৯৭৪ সালে গফুর থাকা অবস্থায় আবাহনী প্রথমবারের মতো লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশের ফুটবলের কত কত মহারথীদের সঙ্গে খেলেছেন তিনি। কাজী সালাউদ্দিনরা ছিলেন তার জুনিয়র। খেলেছেন মাখন দাস, অমলেশদের সঙ্গে। পাকিস্তান জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলেন স্কুটার গফুর। তার ভাষ্যমতে, ৫/৬টা ম্যাচও খেলেছিলেন। তিনি বলেন, 'আমি পাকিস্তান দলে ৫/৬টা ম্যাচ খেলেছি। তবে কোনো গোল করেছিলাম কি না মনে নেই।' পাকিস্তান দলের সঙ্গে রাশিয়া সফরে যাওয়ার কথা ছিল ১৯৬৪ সালে। সেবার নির্বাচকদের কূট চালের কারণে প্লেনে চড়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে তাকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসেন স্কুটার গফুর। ১৯৭১ সালের মার্চে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরই স্কুটার গফুরকে বন্দী করেছিল পাকবাহিনী। নরসিংদীতে বন্দী থাকায় তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে যোগ দিতে পারেননি। এক সময় স্কুটার গফুরকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। তবে স্থানীয় জমিদার পরিবারের খাজা ওহিউদ্দিন তাকে পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত করেন বন্দী হওয়ার ৩/৪ মাস পর। স্বাধীনতার পর আবাহনীতে তিন মৌসুম খেলেই বিদায় জানান ফুটবল ক্যারিয়ারকে। তবে ফুটবল থেকে দূরে থাকেননি তিনি। দীর্ঘদিন নরসিংদী জেলা ক্রীড়া সংস্থায় জয়েন্ট সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।
স্কুটার গফুরের ফুটবল জীবনের মজার স্মৃতির কথা জানতে চাইলে তিনি অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করেও কিছু বলতে পারেননি। পাশে থাকা ভাগ্নে বললেন, আমার একটা দারুণ ঘটনার কথা মনে আছে। একবার নরসিংদী জেলা লিগের ফাইনালে কর্নার কিক থেকে সরাসরি গোল করেছিলেন তিনি। সেই গোলের ছবি এখনো আমার চোখে ভাসে। বুড়ো হয়ে গেছেন স্কুটার গফুর। অতীত এখন তার কাছে কেবলই ভাসা ভাসা ছবি। তারপরও বর্তমান সম্পর্কে খবর নন তিনি। 'আমাদের সময় ফুটবলের যে উন্মাদনা ছিল, শিল্প ছিল তা এখন আর নেই। সেই ফুটবল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে সময় ফুটবলারদের আলাদা কদর ছিল। সবখানে মূল্যায়ন করা হতো।' সেই ফুটবল হারিয়ে যাওয়ার কারণ কি? গফুর বলেন, 'আগে আমরা এত রাজনীতি করতাম না। এখনকার ফুটবলাররা রাজনীতির দিকেই বেশি আগ্রহী।' ফুটবলের এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটা উপায় বাতলিয়েছেন তিনি। পুরনো ফুটবলারদের নিয়ে কাউন্সিল গড়তে হবে। সেই কাউন্সিলের দায়িত্ব হবে নতুন আইডিয়া দিয়ে ফুটবলকে উন্নয়নের পথে পরিচালনা করা। স্কুটার গফুরদের মতো ফুটবলারদের কাছ থেকেই হয়ত উন্নয়নের পথে ছুটে চলার রসদ মিলবে বাংলাদেশের।