শুধু ব্যাট হাতেই নানা রকম সব মাইলসস্টোন উপড়ে ফেলা নয়। অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য খুলে দিয়ে যাচ্ছেন এক নতুন দিগন্তও।
আজহার উদ্দিন থেকে সৌরভ গাঙ্গুলি। রাহুল দ্রাবিড় থেকে মহেন্দ্র সিংহ ধোনি। আধুনিক ক্রিকেট যুগে ভারতীয় ক্রিকেটে ক্ষমতাশালী অধিনায়ক মানে বোর্ডের মধ্যে তার কোনও না কোনও 'গডফাদার' থাকবেই। আজহারের ছিলেন রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর। সৌরভের ছিলেন জগমোহন ডালমিয়া। ধোনির শ্রীনিবাসন। সব রকম ফরম্যাটে অধিনায়ক হয়ে গেলেও কোহালির কিন্তু এখনও তেমন কোনও 'গডফাদার' নেই।
তার পরেও অপছন্দের অনিল কুম্বলেকে সরিয়ে প্রিয় রবি শাস্ত্রীকে কোচ হিসেবে ফিরিয়ে আনার 'মাস্টারস্ট্রোক' নিয়ে ফেলতে পারছেন। হালফিলে শোনা যাচ্ছে, সুপ্রিমকোর্ট নিযুক্ত পর্যবেক্ষকের দল কমিটি অব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরস (সিওএ)-এর জোরাল সমর্থন পাচ্ছেন কোহলি।
বোর্ড সূত্রে জানা, কোচ নিয়ে বিতর্কে সিওএ-র প্রচ্ছন্ন সমর্থন কোহলি পেয়েছেন। তবু বলা যাবে না ভারতীয় ক্রিকেট এখন চালাচ্ছেন দুই 'বি'। সুপ্রিমকোর্ট নিযুক্ত প্রশাসকদের প্রধান বিনোদ রাই এবং অধিনায়ক বিরাট কোহলি।
অধিনায়কদের ক্ষমতা প্রদর্শনের এমন সব টুকরো টুকরো কাহিনী আছে ভারতীয় ক্রিকেটে, যা দিয়ে নিঃসন্দেহে ঠাকুরমার ঝুলি হয়ে যায়। ফ্ল্যাশ ব্যাকে যাওয়া যাক। ডিসেম্বর, ২০০৪। চট্টগ্রামের টিম হোটেল। রাঁচির মহেন্দ্র সিংহ ধোনি নামের এক লম্বা চুলের প্রতিভার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক ঘটতে চলেছে।
কিন্তু আর্জেন্টিনার ফুটবলারের মতো দেখতে ধোনিকে নিয়ে নয়, হোটেলে ভারতীয় দলের অন্দরমহলে ঝড় চলছে অন্য এক ক্রিকেটারকে নিয়ে। সেই তারকা স্পিনারকে আবিষ্কার করা গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। ক্যাপ্টেনের ঘর থেকে বেরিয়েছেন এবং দেখে মনেই হবে না, বিন্দুমাত্র উদ্বেগে রয়েছেন। তারকা স্পিনারের নাম হরভজন সিংহ।
ম্যাচ রেফারি তার বোলিং অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। মারাত্মক ব্যাপার। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে হরভজনের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তার পরেও তাকে চিন্তামুক্ত দেখাচ্ছে!
এতদিন পরে রিওয়াইন্ড করতে বসেও পরিষ্কার মনে পড়ছে হরভজনের নির্লিপ্ত সেই বাক্য- 'দাদি কথা বলছে মিস্টার ডালমিয়ার সঙ্গে। উনি বলেছেন, ব্যাপারটা দেখবেন। আমার সঙ্গে অন্যায় হলে স্যার ছাড়বেন না।'
'দাদি' মানে সৌরভ গাঙ্গুলি। বেহালার ভারত অধিনায়কের পাওয়ার হাউস ছিল কলকাতায় থিয়েটার রোডের একটি অফিস। যেখানে বসে জগমোহন ডালমিয়া এক সময় ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই, চালিয়েছেন বিশ্ব ক্রিকেটও। এমনও ঘটেছে যে, সৌরভকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে বোর্ডের বিরোধী লবি। ডালমিয়া নির্বাচন লড়ে মসনদে ফিরে এসে সৌরভের সিংহাসন রক্ষা করেছেন।
ম্যাচ রেফারি ক্লাইভ লয়েড সৌরভকে দুই ম্যাচের জন্য নির্বাসিত করার পরে ডালমিয়া আইনজীবী করে নিয়ে আসেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে। তার অসাধারণ আইনি প্রজ্ঞাকে অস্ত্র করে আইসিসি'র বিরুদ্ধে মামলা জেতে বোর্ড। নির্বাসন উঠে গিয়ে ফের মাঠে নামেন সৌরভ।
প্রভাবশালী বোর্ড প্রশাসকের সমর্থনের জোরে শক্তিশালী হয়েছিলেন আজহার উদ্দিনও। তার অধিনায়কত্ব পাওয়ার সময়ে সেই ঐতিহাসিক সংলাপ-'মিঞা কাপ্তান বনোগে?' যিনি প্রশ্নটা করেছিলেন, সেই প্রয়াত রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর সারা জীবন সমর্থন করে গিয়েছেন প্রিয় আজ্জুকে। এতটাই স্নেহপ্রবণ ছিলেন 'কাপ্তান'র প্রতি যে, ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগও সেই ভালোবাসায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। কতটা ক্ষমতাশালী ছিলেন আজহার? একটা উদাহরণই যথেষ্ট। সুনীল গাভাস্কারকে পর্যন্ত একবার আক্রমণ করে বলেছিলেন, 'উনি আমার সম্পর্কে ঈর্ষাকাতর।'
তেমনই আইপিএল যুগে চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে ধোনি-শ্রীনি যুগলবন্দি। যদিও তাদের জুটি নিয়ে প্রচুর বিতর্কও হয়েছে। শ্রীনির ইন্ডিয়া সিমেন্টসের পদাধিকারী হয়েছেন ধোনি। যা নিয়ে অপ্রীতিকর প্রশ্ন উঠেছে। আইপিএলে শ্রীনির চেন্নাই সুপার কিংগসের অধিনায়ক ধোনি। তাদের মধুচন্দ্রিমার নমুনা?
অস্ট্রেলিয়ায় টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হওয়ার পরে ধোনিকে ছেঁটে ফেললেন জাতীয় নির্বাচকেরা। অধিনায়ক বানিয়ে দিলেন কোহলিকে। ছুটির দিনে গলফ খেলছিলেন শ্রীনি। ওদিকে নির্বাচকদের তরফ থেকে বার বার ফোন যাচ্ছে তার কাছে কারণ, বোর্ডের নিয়ম হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের অনুমোদন ছাড়া দল ঘোষণা করা যাবে না।
খবর শুনে হন্তদন্ত হয়ে মিটিং স্থলে এলেন শ্রীনি। শোনা যায়, দরজা ধড়াস করে খুলে ঘরে ঢুকে সে দিন নির্বাচকদের ওপর ঝড় বইয়ে দেন বোর্ড প্রেসিডেন্ট। উত্তেজিতভাবে এমনও নাকি বলেন যে, তোমরা আমার গলফ ডে নষ্ট করে দিলে। এরপর নির্বাচকদের বাধ্য করেন কোহলির নাম কেটে ফের ধোনিকে অধিনায়ক হিসেবে রেখে দিতে।
প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে যেমন একজন নারী, তেমন প্রত্যেক সফল অধিনায়কের পিছনে একজন ক্ষমতাশালী বোর্ড প্রেসিডেন্ট। এই কারণেই অধিনায়ক কোহলি ঐতিহাসিক চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন, যেহেতু তিনি এই 'ট্রেন্ড'কে পাল্টে দেওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। বোর্ডে 'পাওয়ারহাউস'র আশেপাশে না থেকেও তিনি ক্ষমতাশালী। পছন্দ হোক বা না হোক, তার যুক্তি মেনে নিতেই হচ্ছে। ব্যাটের জোর আর জনপ্রিয়তার হাওয়ায় এমনই অবিসংবাদী নায়ক এখন কোহলি।
ব্যাট হাতে নানা রেকর্ড ভাঙতে থাকবেন ভারতীয় ক্রিকেটের পোস্টার বয়। পাশাপাশি, অধিনায়কত্বের নতুন টেমপ্লেটও হয়তো তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছেন কোহালি!
সূত্র: আনন্দবাজার
বিডি প্রতিদিন/১২ জুলাই ২০১৭/আরাফাত