বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারি, ২০১৮ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, একদফা দাবির কথা তোরা বল!

বঙ্গবন্ধু হেসে বললেন, একদফা দাবির কথা তোরা বল!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পঞ্চমবারের মতো ব্রিটেনে আসেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে ছাড়া পাওয়ার ৮ মাস পর, ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর। ব্রিটেন আসার তিন দিন আগে ১৯৬৯ সালের ২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম সংবাদপত্র দৈনিক ইত্তেফাকে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটেন সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যেদিন আমাদের আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল সেদিন প্রবাসী বাঙালির হৃদয় কাঁদিয়া উঠিয়াছিল। তাহারা আমাদের পক্ষ সমর্থনের জন্য নিজেদের অর্থ ব্যয় করিয়া বিশিষ্ট আইনজীবী টমাস উইলিয়ামকে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার থেকে কুর্মিটোলার বিচার কক্ষে পাঠিয়েছিলেন। সে দিনও প্রবাসী বন্ধুরা আওয়ামী লীগের বন্যাদুর্গত তহবিলে ৫ হাজার ৬৮০ টাকা প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং তাহাদের সংগ্রামী ভূমিকার প্রতি একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশে লন্ডন যাওয়া আমি কর্তব্য বলিয়া বিবেচনা করি।

৩০ অক্টোবর দৈনিক ইত্তেফাকে বঙ্গবন্ধুর ব্রিটেন পৌঁছানোর এক সংবাদে বলা হয়, প্রতিকূল আবহাওয়া স্বত্ত্বেও কয়েক হাজার পাকিস্তানি হিথ্রো এয়ারপোর্টে সমবেত হয় এবং ছয়দফা কর্মসূচি, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানে সত্বর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সমর্থনে স্লোগান দেয়। শেখ সাহেবকে বিপুলভাবে মাল্যভূষিত করা হয় এবং জনতা তার ওপর ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করে।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে এয়ারপোর্টে ব্রিটিশ সরকারের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সেদিন তাকে স্বাগত জানান। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, তাসাদ্দুক আহমেদ, গাউস খান, মুহিবুর রহমান, মিনহাজ উদ্দিন, সুলতান মাহমুদ শরীফ, জাকারিয়া খান চৌধুরীসহ ছাত্র-জনতা শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাগত জানান। এরপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মাউন্ট রয়্যাল হোটেলে।

এ সময় প্রতিদিন বহু বিদেশি সাংবাদিক, ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ছাড়াও আইনজীবী টমাস উইলিয়াম ও পাকিস্তানের প্রধান বৈজ্ঞানিক ও পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক আবদুস সালামও ছিলেন।

সেই সফরে বঙ্গবন্ধুকে দুটি গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। অংশ নেওয়া ছাড়াও তিনি ৯১ হাইবারি হিল, লন্ডন এন-৫-এ অবস্থিত ইস্ট পাকিস্তান হাউস ও পূর্ব লন্ডনে অবস্থিত শহীদ ভবন দেখতে যান।

১ নভেম্বর ইস্ট লন্ডনের গ্রান্ড প্যালেসে দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায় উপস্থিত ছিলেন কয়েক হাজার লোক। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, যারা তার মুক্তিতে সাহায্য করেছেন তাদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা তার লক্ষ্য। তবে বিদেশ থেকে আমদানি করা সমাজতন্ত্রের নীতিতে তিনি বিশ্বাসী নন। ২ নভেম্বর বার্মিংহামের ডিগবেথ সিভিক হলে গাউস খানের সভাপতিত্বে এবং হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভার শুরুতে তিনি জানান, ঢাকায় সামরিক বাহিনীর লোকেরা জনতার ওপর গুলি চালিয়ে ১০ জনকে হত্যা করেছে। এজন্য তিনি তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। তিনি আরও বলেন, যে জনগণ রক্ত দিয়ে আমাকে মুক্ত করেছেন, আমি বেঁচে থাকতে তাদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। বার্মিংহামের সভার পরদিন ৩ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু পশ্চিম লন্ডনের টুইকেনহামে অবস্থিত শিশ কাবাব রেস্টুরেন্টে ইস্ট পাকিস্তান ডিফেন্স ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে মিলিত হন। ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায় সুরমা ব্লু রেস্টুরেন্টে পাকিস্তান যুব ফেডারেশন-এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন।

১৯৬৯ সালের সেই সফরে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে কথা বলে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার চূড়ান্ত সময় এসে গেছে। তাই আওয়ামী লীগ যুক্তরাজ্য শাখা গঠনের পাশাপাশি আকারে-ইঙ্গিতে তখন এ কথাটি বুঝিয়ে যান যে এখন আর ছয়দফা নয়, একদফা। এ প্রসঙ্গে সাপ্তাহিক জনমতের সম্পাদক এ টি এম ওয়ালী আশরাফ বলেন, শেখ মুজিব আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর একবার লন্ডনে এসেছিলেন। একদিন আমি, আমাদের পত্রিকা জনমতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমানের জামাই ড. ওয়াজেদ মিয়া, সাংবাদিক মরহুম নিজামুদ্দিন শেখ মুজিবের সঙ্গে হোটেলে দেখা করি। কথা প্রসঙ্গে তাকে বললাম, আপনি ছয়দফার বদলে একদফা বলছেন না কেন? তিনি হেসে বললেন, তোরা বল! আমরা বুঝলাম তিনি কী নির্দেশ দিলেন। আমরা জনমতের প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম দিলাম—‘স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালির গত্যন্তর নেই।’

সর্বশেষ খবর