আদিম যুগ থেকে মানুষ বাঁচার তাগিদে বা জীবনযাপন সহজ করতে বিভিন্ন উপায় খোঁজে। আবিষ্কার করে নানান জিনিস। জীবনের ঝুঁকি কমাতে ও পরিশ্রম লাঘব করতে বিভিন্ন অস্ত্র ও সরল যন্ত্র তৈরি করে। নতুন নতুন উপায় ও পদ্ধতিতে বদলে ফেলে জীবনযাপনের ধারা। নতুনের প্রতি আকাঙ্খা ও আবিষ্কারের নেশা মানুষকে ক্রমাগত এগিয়ে নিচ্ছে। বিখ্যাত কয়েকটি আবিষ্কারের গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন-
বৈদ্যুতিক বাতি
রাতের আঁধার দূর করে বৈদ্যুতিক বাতি শুধু চারপাশ আলোকিতই করেনি, মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করেছে। এর আবিষ্কারের পেছনে অনেক বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রম রয়েছে। ১৮০০ সালের দিকে ইতালীয় বিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টারের হাত ধরে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটে। এরপর হামফ্রি ডেভি নামের একজন বিজ্ঞানী ভোল্টাইক পাইলকে চারকোল ইলেকট্রোডের সঙ্গে যুক্ত করে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। এভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞানীর হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে বৈদ্যুতিক বাতি আবিষ্কারের প্রক্রিয়া। এ যাত্রার শেষ হয় জোসেফ সোয়ান ও টমাস আলভা এডিসনের হাত ধরে। জোসেফ সোয়ান ১৮৫০ সালের দিকে ভ্যাকুয়াম টিউবের ভিতর ফিলামেন্ট রেখে বাতি জ্বালানোর কৌশল দেখান। ফিলামেন্ট হিসেবে তিনি কার্বনযুক্ত কাগজ ব্যবহার করেন। তবে সে সময়ে এ ভ্যাকুয়াম টিউবের পদ্ধতি ছিল বেশ ব্যয়বহুল। ফলে তাঁর এ পদ্ধতি শুধু আবিষ্কার হিসেবেই অসাধারণ ছিল, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারের জন্য নয়। টমাস আলভা এডিসন এ সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। তাঁর ধারণা ছিল, যদি ফিলামেন্টটিকে পাতলা ও কোনো অধিক রোধের বস্তু দিয়ে তৈরি করা যায়, তাহলে খুব অল্প বিদ্যুতেই জ্বলে উঠবে। এ ধারণার ভিত্তিতে ১৮৭৯ সালে তিনি তাঁর আবিষ্কারটি প্রকাশ করেন। এরপর এডিসন ও তাঁর দল বিভিন্নভাবে এ বাতিকে সহজলভ্য ও টেকসই করার জন্য গবেষণা করেন।
চাকা
মানুষের জীবনধারাকে আমূল বদলে দেওয়া প্রথম আবিষ্কার ছিল চাকা। ৩৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এ সামান্য আবিষ্কারটিই বিজ্ঞানের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। চাকা কে আবিষ্কার করেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয় সভ্যতায় এর প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে মানুষ অনেকটা চাকার ওপর নির্ভরশীল। দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত কিংবা ভারী মালপত্র বহনে যানবাহন ব্যবহারের সূত্রপাত চাকার হাত ধরেই। সভ্যতার অগ্রগতিতে জলে, স্থলে বা আকাশে গমন করতে পারে, এমন অনেক বাহন মেলে; কিন্তু সব কিছুর সূত্রপাত হয়েছে চাকা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। সভ্যতার শুরুতে মানুষকে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হতো। মালপত্র পরিবহন থেকে শুরু করে যে কোনো পরিবহনের জন্য মানুষকে নির্ভর করতে হতো কায়িক শ্রমের ওপর। মাঝে মাঝে বিভিন্ন পশুকে তাদের এ পরিবহন মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত; কিন্তু সেটিও ছিল সংক্ষিপ্ত।
কাগজ
কাগজ আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় ২ হাজার বছর পুরোনো। সেকালে চীনারা কাপড়ের তৈরি চাদর বিভিন্ন ধরনের অঙ্কন ও লেখার কাজে ব্যবহার করত। কাগজ বলতে বর্তমান সময়ে আমরা যেটি বুঝি, তার আবিষ্কার চীনের একজন কোর্ট অফিশিয়াল সাইলুনের হাত ধরে হয়েছিল। তিনি তুঁতের বাকল, শাঁস ও পানি মিশিয়ে এক ধরনের মণ্ড তৈরি করতেন। এই মণ্ডকে চাপ দিয়ে পাতলা করে রোদে শুকাতেন। অষ্টম শতাব্দীর দিকে কাগজ তৈরির এ পদ্ধতি সম্পর্কে মুসলিম শাসকরা জানতে পারেন। পরবর্তীতে তাদের হাত ধরে ইউরোপে এ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে। এরপর স্পেনে প্রথম কাগজকল স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে সমগ্র ইউরোপে এমন অসংখ্য কাগজকল স্থাপিত হতে থাকে। অবশ্য তখন কাগজ শুধু দরকারি নথি ও বই ছাপাতে ব্যবহৃত হতো। সর্বসাধারণের কাছে কাগজ পৌঁছে দেয় মূলত ব্রিটিশরা। ১৫ শতকের দিকে তারা সুপরিসরে কাগজ উৎপাদন করে উপনিবেশভুক্ত দেশগুলোতে ছড়িয়ে দেয়। বর্তমানে কাঠ দিয়ে কাগজ তৈরির পদ্ধতিটি এসেছিল আমেরিকানদের হাত ধরে।
প্রিন্টিং প্রেস
পঞ্চদশ শতাব্দীর অন্যতম আবিষ্কার হলো প্রিন্টিং প্রেস। এটি এমন এক যান্ত্রিক পদ্ধতি, যা কোনো কাগজ বা কাপড়ের পিঠে চাপ প্রয়োগ করে কালি বা রঙের একটি আস্তরণ তৈরি করে। এই আস্তরণ হতে পারে কোনো লেখা, নকশা বা চিত্র। কয়েক বছর আগেও এমন পদ্ধতি ব্যবহার করে লেখা বা চিত্র প্রিন্ট করা হতো। জোহানেস গুটেনবার্গকে মূলত প্রিন্টিং প্রেসের আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয়। ১৪৪০ সালের দিকে তিনি এটি আবিষ্কার করেন। তিনি ছিলেন জার্মানের অধিবাসী। পেশায় একজন স্বর্ণকার। তার এ আবিষ্কারের প্রায় ৬০০ বছর আগে চীনা সাধকরা ব্লক প্রিন্টিং নামের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। এ পদ্ধতিতে কাঠের তৈরি কোনো ব্লকে কালি লাগিয়ে কাগজের পিঠে নকশা বা লেখা প্রিন্ট করা হতো। এ পদ্ধতির প্রচলন অষ্টম শতকে কোরিয়া ও জাপানে প্রচলিত ছিল। এরপর এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে জাইলোগ্রাফি নামে ইউরোপে আরেকটি প্রিন্টিং পদ্ধতি চালু ছিল। তবে সব কিছুর অবসান ঘটে গুটেনবার্গের আবিষ্কারের মাধ্যমে। তিনি এমন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে হাতে হাতে প্রেসিং করে মুদ্রণ করার বদলে মেকানিক প্রেসিং করা যেত। তার এ যন্ত্রটি অ্যাসেম্বলি লাইন পদ্ধতি ব্যবহার করত; যা ছিল হাতে প্রিন্টিংয়ের চেয়ে অধিকতর দক্ষ। ফলে আগের চেয়ে উন্নত ও দ্রুত প্রিন্টিংয়ে যন্ত্রটি ছিল এগিয়ে।
অ্যান্টিবায়োটিক
প্রাচীনকালে বিভিন্ন ছত্রাক ও গাছের লতাপাতার নির্যাস দিয়ে সংক্রমণের চিকিৎসা করত মানুষ। প্রাচীন মিসরীয়রা ময়লার মতো দাগ পড়ে যাওয়া পাউরুটিকে সংক্রমণ স্থলে লাগিয়ে চিকিৎসা করত। চীনারা সয়াবিনের ছত্রাক আক্রান্ত বীজ ফোঁড়ার চিকিৎসায় ব্যবহার করত। গ্রিক ও ভারতীয়রা ক্ষতস্থানের সংক্রমণ দূর করতে ছত্রাক ও বিভিন্ন উদ্ভিদের ব্যবহার করত। জার্মানের শারীরতাত্ত্বিক পল এরলিক ১৯০৯ সালে আর্সফেনামিন নামক রাসায়নিক প্রয়োগে ব্যাকটেরিয়া মারতে সক্ষম হন। এর মাধ্যমে আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিকের যাত্রা শুরু। তবে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের মূল নায়ক হলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। বিভিন্ন উন্নতি সাধনের পর ১৯৪৪ সালে পেনিসিলিন সারা বিশ্বে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমান সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসাপদ্ধতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ এটি। পেনিসিলিন ছিল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের বিরুদ্ধে কাজ করা প্রথম ওষুধ; যা অনেক গুরুতর সংক্রমণ, যেমন- সিফিলিসের বিরুদ্ধে কার্যকর। পেনিসিলিন এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কম্পিউটার
বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর আবিষ্কার হলো কম্পিউটার। যে কাজগুলো আগে মানুষের করতে মাথার ঘাম ছুটে যেত, সেসব মুহূর্তেই কম্পিউটারের সাহায্যে করা যায়। চার্লস ব্যাবেজকে আধুনিক কম্পিউটারের জনক বলা হয়। তবে কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস প্রায় ৫ হাজার বছরের পুরোনো। এ আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় অ্যাবাকাস নামে এক ধরনের গণনাযন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় ব্যবহৃত হতো এ অ্যাবাকাস নামক যন্ত্রটি। এরপর উল্লেখযোগ্য গণনাযন্ত্র ছিল জন নেপিয়ারের আবিষ্কৃত নেপিয়ারের বোন যন্ত্র। এ যন্ত্রে ব্যবহৃত হতো ৯টি ভিন্ন ভিন্ন বোন বা হার; যা দিয়ে গুণ বা ভাগ করা যেত। এ যন্ত্রেই সর্বপ্রথম দশমিক সংখ্যাপদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এরপর অবশ্য সপ্তদশ শতক পর্যন্ত গণনাযন্ত্রের উল্লেখযোগ্য বিকাশ হয়নি। তবে এই খরা কাটে ব্রেইজ প্যাসকেলের হাত ধরে। তিনি সর্বপ্রথম ক্যালকুলেটিং মেশিন আবিষ্কার করেন। বর্তমানে যা আমরা ক্যালকুলেটর নামে চিনি। তার এই ক্যালকুলেটর দিয়ে যোগ-বিয়োগ করা গেলেও গুণ ও ভাগ করা যেত না। পরবর্তীতে প্যাসকেল বিভিন্ন সময় এ যন্ত্রের উন্নতি সাধন করেন। তার পরেই কম্পিউটার বা গণকযন্ত্রের ইতিহাসে যোগ হয় বিখ্যাত গণিতবিদ জার্মান ভিলহেলম লিবনিজের নাম। লিবনিজের গণকযন্ত্র যোগ-বিয়োগ তো করতে পারতই, গুণ-ভাগ এমনকি সংখ্যার বর্গমূল পর্যন্ত বের করে দিত। এরপর ১৮৩৬ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী চার্লস ব্যাবেজ তৈরি করেন উন্নতমানের এক গণনাযন্ত্র; যার নাম এনালাইটিক ইঞ্জিন। এটি ছিল এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় গণনাযন্ত্র। এটি তথ্য সংগ্রহে সক্ষম ছিল। ১৯৪৪ সালে বিশ্বে সর্বপ্রথম স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার তৈরি করেন অধ্যাপক হাওয়ার্ড আইকেন ও আইবিএমের প্রকৌশলীরা। কম্পিউটারটি তৈরি করা হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। মার্ক ওয়ান নামে যার প্রসিদ্ধি ছিল। এটি অনেক বড় গাণিতিক হিসেবে পারদর্শী ছিল। ধীরে ধীরে এগোতে থাকে কম্পিউটারের উন্নতি সাধন।
ইন্টারনেট
বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির। এটি সম্ভব হয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। কম্পিউটার জগতেও বিপ্লব এনেছে ইন্টারনেট। ইন্টারনেট বিশ্বব্যাপী তথ্য আদান-প্রদান ও প্রচারের জন্য অভূতপূর্ব মাধ্যম। ১৯৬০ সালের গোড়ার দিকে ইন্টারনেটের আবিষ্কার। এম-আইটির জেসিআর লিক্লাইডার ‘ইন্টারগ্যালাক্টিক নেটওয়ার্ক’ নামক একটি ধারণার জন্ম দেন। এ পদ্ধতিতে সব কম্পিউটারকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় আনার পরিকল্পনা করেন। ১৯৬০ সালের শেষদিকে অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সি নেটওয়ার্কের উদ্ভাবন হয়। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের অর্থায়নে তৈরি নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা; যা কয়েকটি কম্পিউটারকে একটি নির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসত। ১৯৮৩ সালের পর থেকে বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে আধুনিক ইন্টারনেট আবিষ্কারের দিকে এগোতে থাকেন। এ প্রক্রিয়া এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি করে বিখ্যাত কম্পিউটার বিজ্ঞানী টিম বার্নাস লির ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব আবিষ্কারের মাধ্যমে। তাঁর আবিষ্কার আজকের হাইপার-লিংক বা ওয়েবসাইটভিত্তিক ইন্টারনেটের সূত্রপাত ঘটায়।