আজ ১৭ অক্টোবর, বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। ১৯৮৭ সাল থেকে জাতিসংঘ ১৭ অক্টোবরকে বিশ্ব দারিদ্র্য বিমোচন দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। যেসব দেশ দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে থাকে, সাধারণত সেসব দেশে এই দিবসটি উদযাপন করা হয়। সে হিসেবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের হার জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টিতে শুধু উল্লেখযোগ্য নয়, একটি বিস্ময়ও বটে! তাই এবার বাংলাদেশে এ দিবসটি উদযাপন হচ্ছে আজ ১৭ অক্টোবর। এ উপলক্ষে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম ১৬ থেকে ১৮ অক্টোবর তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে গতকালই এসে পৌঁছেছেন। এটি বাংলাদেশে তার প্রথম সফর।
বিশ্বায়নের এ যুগে সারা বিশ্বকে একটি গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বগ্রাম বলা হয়ে থাকে। সে হিসেবে বাংলাদেশও একটি গ্রাম। আজ থেকে ৪৪ বছর আগে এই গ্রামটির জন্ম হয়। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে এ গ্রামটির পত্তন হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পুল-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ প্রভৃতি ধ্বংস হয়। ফসল বিনষ্ট হয়। এসব কারণে জন্মের প্রথম তিন-চার বছরে গ্রামবাসীকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। ভিনদেশি মোড়লরা যারা আমাদের গ্রামটির জন্ম চায়নি, তাদের অনেকেই আমাদের গ্রামকে স্বীকার করে নিতে তিন-চার বছর সময় লাগিয়েছে। তখন ছিল দুঃখের দিন। কিন্তু চিরকাল মানুষের সমান যায় না। আকাশের রং বদলায়, প্রকৃতিও রং বদলায়, মানুষেরও জীবন বদলায়। যদি সঠিক নেতৃত্বের হাতে পড়ে। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রামের প্রধান বা মোড়ল হন ধর্মপ্রাণ এক মহিলা রাজনীতিক, যার পিতা এ গ্রামের জনক। ধীরে ধীরে পরিকল্পিতভাবে দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া শুরু হয়।
সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে হতদরিদ্র নারী-পুরুষের কাছে কাজ, নগদ অর্থ, গৃহনির্মাণ সামগ্রীসহ বিবিধ সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। অবশ্য এর আগে পূর্বের মোড়লরাও দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। দেখতে দেখতে গত সাত বছরে অকল্পনীয়ভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য আসতে থাকে। অতিদরিদ্রের সংখ্যা কমতে থাকে। ২০০৫ সালে যেখানে অতিদরিদ্রের সংখ্যা ছিল ৪৩ শতাংশ, ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে তা নেমে আসে ১৮ শতাংশে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে তা নেমে ১২.৯ শতাংশে দাঁড়ায়। গত ৭-৮ বছরে প্রায় এক কোটি লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। এটি একটি বিশাল অর্জন-বড় সুসংবাদ। এটি নজরে আসে ভিন গ্রামের বড় বড় মোড়লদের, নড়ে-চড়ে বসে তারা। বঙ্গগ্রাম নামে ছোট্ট একটি ভূখণ্ডে ১৬ কোটি লোক ঠাসাঠাসি বাস করে— যে গ্রামে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, বরং বানভাসি-বন্যা যার নিত্যসঙ্গী, তারা কীভাবে পারল এত দ্রুত অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা এভাবে কমিয়ে আনতে। ব্যাপারটা তো সরেজমিন গিয়ে দেখতে হয়। তাই বিশ্বের অর্থকড়ি লেনদেনের বড় আড়ত ‘বিশ্বব্যাংক’-এর সভাপতি নিজেই ছুটে এসেছেন। আজ তিনি আমাদের মোড়ল ও তার লোকজনের মুখে এ উন্নয়ন-বিস্ময়ের রহস্যগাথা শুনবেন।নিয়তির কী পরিহাস! মাত্র বছরতিনেক আগে বঙ্গগ্রামে একটি বড় সাঁকো বা সেতু নির্মাণে কিছু অর্থ সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে এ বিশ্বআড়তদার কী ভূমিকাটাই না নিয়েছিল! পদ্মা নদীর ওপরে একটি সেতু নির্মিত হলে দক্ষিণাঞ্চলের ৩ কোটি লোক উপকৃত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, অর্থ, সময়, শ্রম সবদিক দিয়ে সাশ্রয়ী হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি হয়। কিন্তু বিশ্বআড়তের মুরব্বিরা কাজ শুরুর আগেই দুর্নীতির গন্ধ পান। তার পরের কাহিনী অনেক লম্বা। আজ অতিথির উপস্থিতিতে সেগুলো আর তুলতে চাই না। তবে এটা ঠিক, আমাদের দৃঢ়চেতা মোড়ল আড়তদারের মুখের ওপর সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের অর্থের প্রয়োজন নেই, আমরা নিজ টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করব’। তার কথানুযায়ী আজ পদ্মা সেতুর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, এটি এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। এটি একটি বড় সুসংবাদ।
শুধু কী দারিদ্র্য বিমোচন, বিশ্ববেপারিরা কবছর আগে সব গ্রামের জন্য সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এমডিজি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে এ ছোট্ট বঙ্গগ্রামের সাফল্য বিস্ময়কর। স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে, পুরুষ প্রায় ৭৩ বছর এবং নারী ৭৫ বছর। শিক্ষার হার (স্বাক্ষরতাসহ) বর্তমানে ৭২.৪ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার বর্তমানে ৮ শতাংশ। এনরোলমেন্ট শতভাগ। এ ছাড়া শিশুমৃত্যুর হার বর্তমানে প্রতি হাজারে ৪৬ জন। নবজাতক প্রতি হাজারে ২২ জন। এসবই একটি দেশের উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি। বর্তমানে আবার জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনেও বাংলাদেশ সাফল্য লাভ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে অতি দারিদ্র্যের হার শূন্য কোঠায় বা তিন শতাংশের নিচে নামানোর লক্ষ্যমাত্রাও ইনশা আল্লাহ বাংলাদেশ অর্জন করতে পারবে। বিশ্বমন্দারকালেও এ গ্রামের অর্থনীতি মজবুত ছিল। প্রবৃদ্ধির হার সব সময় ৬ শতাংশের ওপরে ছিল। এবার ২০১৬ সালে তা ৭ শতাংশ অতিক্রম করবে আশা করা যায়। অন্যদিকে মুদ্রাস্ফীতির হার ২০১৫ সালের ৬.৫ শতাংশের চেয়ে কমে ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ৫.৬৫ শতাংশে ঠেকেছে। এসবই অর্থনীতির জন্য সুসংবাদ।
শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধির হার গত বছরের ৯.৬৭ শতাংশের চেয়ে বেড়ে ১০.১০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। সেবা খাতে বৃদ্ধি ৫ শতাংশ হতে ৬.৭০ শতাংশ। মৎস্য খাতের প্রবৃদ্ধি ৬.১৯ শতাংশ। ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে প্রবৃদ্ধি ১০.৩০ শতাংশ। বিদ্যুৎ, গ্যাস খাতে ১১.১৫ শতাংশ। নির্মাণ খাতে ৮.৮৭ শতাংশ।
লেখক : সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা।