শুক্রবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

পবিত্র ঘর কাবার আদি কথা

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

পবিত্র ঘর কাবার আদি কথা

‘পবিত্র কাবা ঘরকে সমগ্র মানব জাতির কল্যাণের প্রতীক হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন আল্লাহ।’ (সূরা মায়েদাহ : ৯৭)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই মানব জাতির প্রথম ইবাদত-ঘর প্রতিষ্ঠিত হয় মক্কায়, যা আশীর্বাদধন্য ও বিশ্বাসীর জন্য আলোক দিশারী। এখানে আছে মাকামে ইবরাহিমের মতো সুস্পষ্ট নিদর্শন। যে এখানে প্রবেশ করবে, অন্তরের প্রশান্তি পাবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)। বাইতুল্লাহ বা কাবা ঘর বলে আজ আমরা যা দেখছি তা কিন্তু শুরুতে এমন ছিল না। এর ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের মতোই প্রাচীন। কোরআনে বলা হয়েছে, এটি পৃথিবীর প্রথম ঘর। আমাদের বাবা আদম এবং মা হাওয়া (আ.) যখন পৃথিবীতে আসেন তখন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে আদম! আমি তোমাদের জন্য একটি ঘর নির্ধারণ করলাম। এ ঘরের তাওয়াফ সেভাবেই করবে যেভাবে আমার আরশের তাওয়াফ করা হয়।’ হজরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি ঘর নিয়ে আসেন এবং এখন যেখানে বাইতুল্লাহ আছে সেখানে স্থাপন করেন। তাহলে দেখা যায়, বাইতুল্লাহর প্রথম ভিত্তিস্থাপন ও নির্মাণ করেন স্বয়ং জিব্রাইল ফেরেশতা।  আদম (আ.) এরপর অনেক বছর কেটে যায়। চলছে হজরত নূহ (আ.) এর যুগ। কী বেয়াড়াই না ছিল নূহ নবীর উম্মত। সাড়ে নয়শ বছর দাওয়াতি কাজ করেও হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া আর কাউকে দলে ভেড়াতে পারলেন না তিনি। আল্লাহ ঠিক করলেন প্রবল বন্যা দিয়ে এ জাতিকে ধ্বংস করে দেবেন। শুরু হলো তুমুল বর্ষণ। তলিয়ে গেল পৃথিবী। এ সময় কাবা ঘরকে হজরত জিব্রাইল (আ.) আবার উঠিয়ে নিলেন। বন্যা শেষ হলো। পৃথিবীতে আবার আবাদ শুরু হলো। সবুজে সবুজে ভরে উঠল পৃথিবী। মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলো। নূহ (আ.) চলে গেলেন প্রিয়তম আল্লাহর কাছে। তারপর অনেক নবী এলেন গেলেন। এরই ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর মানুষকে নাজাত দিতে নাজিল হলেন আমাদের আরেক পিতা ইবরাহিম (আ.)। কত শত চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অর্জন করলেন, ‘খলুিল্লাহ’—আল্লাহর অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সার্টিফিকেট। জীবন সূর্যের ডুবন্ত বেলায় এক পুত্রসন্তান দান করলেন আল্লাহতায়ালা। ঘোষণা হলো এ পুত্র এবং তার মাকে রেখে আসো নির্জন প্রান্তরে। একে তো বৃদ্ধ বয়সের সন্তান, তার ওপর একমাত্র ছেলে। ইবরাহিম নবীর পক্ষেই সম্ভব হয়েছে খোদার প্রেমের খেলায় কোরবানি হতে। তিনি স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে চলে এলেন মক্কার এক নির্জন মরুভূমিতে। তাদের সেখানে রেখে ফিরে এলেন নিজ এলাকায়। আল্লাহর কাছে প্রার্থনার দুটি হাত তুলে চোখ ভিজিয়ে বললেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার পরিবারের ক’জন সদস্যকে তোমার সম্মানিত ঘরের পাশে এক অনুর্বর উপত্যকায় পুনর্বাসিত করলাম, যাতে তারা সালাত কায়েম করতে পারে। অতএব তুমি কিছু মানুষের মনে তাদের প্রতি ভালোবাসা জন্ম দিও। ফল-ফলাদি ও জীবনোপকরণের সুন্দর ব্যবস্থা করে দিও। আশা করা যায়, ওরা শোকর গুজার করবে।’ (সূরা ইবরাহিম : ৩৭)।

ইবরাহিম (আ.) জানতে পেরেছেন, এ নির্জন ভূমির আশপাশেই বাইতুল্লাহ ছিল। তাই তিনি দোয়ায় ওই ঘরের উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, ‘আমি আমার পরিবারের ক’জন সদস্যকে তোমার সম্মানিত ঘরের পাশে...।’ মুফাসসিরগণ বলেছেন, কাবার অস্তিত্ব কখনই ধ্বংস হয়নি। পুরো ঘরটি অযত্বে-অবহেলায় ধসে পড়েছিল ঠিক, কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। ইবরাহিম (আ.) ওই জীর্ণশীর্ণ পড় পড় ইমারতের আশপাশেই স্ত্রী-পুত্রকে রেখে আসেন। 

এর কয়েক বছর পর ইসমাইলকে নিয়ে ইবরাহিম (আ.) কাবা ঘরের সংস্কার করেন। নতুন অবয়বে চমত্কার কারুকাজে ঘরটি নতুন করে নির্মাণ করেন। কোরআনে এ ঘটনাটি এভাবে বলা হয়েছে, ‘যখন ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) কাবা ঘরের দেয়াল তুলছিলেন তখন তারা দোয়া করেছিলেন, হে আমাদের প্রভু! তুমি আমাদের এ মেহনত কবুল কর। তুমি সব শোন, সব জানো।’ (সূরা বাকারাহ : ১২৭)। হজরত ইবরাহিম এবং ইসমাইল (আ.)-এর নির্মাণ করা কাবা ঘরই আজকের আধুনিক বাইতুল্লাহ। যুগে যুগে এর সংস্কার হয়েছে ঠিক, তবে আর কখনই তা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেনি। কারণ, কাবা ঘর নির্মাণ করেই ইবরাহিম (আ.) এ ঘরে হজের আজান ঘোষণা করে দেন। তার উম্মতও এ ঘরকে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে প্রাণবন্ত করে রাখেন। সময়ের ব্যবধানে এ ঘরে তাওহিদের পরিবর্তে শিরকের চর্চা হতে থাকে। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) এসে এ ঘরে চির দিনের জন্য তাওহিদের বাতি জ্বেলে দেন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

            www.selimazadi.com

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর