শিরোনাম
রবিবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৭ ০০:০০ টা
ধর্মতত্ত্ব

শরতের মতো শুভ্র হোক হৃদয়ের আয়না

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

শরতের মতো শুভ্র হোক হৃদয়ের আয়না

বর্ষণমুখর দিনের পর বাংলার প্রকৃতিতে ডানা মেলেছে শুভ্র শরৎ। শরতের কথা মনে পড়তেই নীল আকাশ ও সাদা কাশফুলের ছবি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। নদীর চরে, বিলের ধারে মাথা উঁচিয়ে থাকা কাশফুলের সারিই যেন জানিয়ে দিচ্ছে শরৎ এসেছে। আকাশের ভেলায় ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো টুকরো টুকরো মেঘ উঁকি দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। আকাশের মেঘ ও কাশের ফুল— এ দুটোই শরতের প্রধান আকর্ষণ। এ ছাড়াও শরতে ফোটে শিউলি-জুঁই, শাপলা-পদ্মসহ জানা-অজানা হরেক ফুল। ফসলের মাঠে সবুজের হাসি লেগে থাকে ধানের ডগায় ডগায়। চারদিকে বিরাজ করে শান্ত-স্নিগ্ধ আবহাওয়া। দেখে মনে হবে এ যেন স্বর্গেরই আরেক রূপ।

শরতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো শুভ্রতা। আকাশে-জমিনে সর্বত্রই শুভ্রতার ছড়াছড়ি। তা ছাড়া হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি এসে সবকিছু ধুয়ে-মুছে দেয় নিমিষেই। তখন শুভ্রতা আরও উজ্জ্বল হয়ে ধরা দেয় মানুষের হৃদয়ে। শরতের বৃষ্টিস্নাত প্রকৃতি দেখা মাত্রই মনের আকাশে উঁকি দেয় নতুন স্বপ্ন। হৃদয়ের তারে বেজে ওঠে নতুন গান। মন বলে, আমিও যদি পারতাম নিজেকে ধুয়ে-মুছে এভাবে তকতকে ঝকঝকে হতে। পাপ-তাপে ভরা আমার হৃদয়ের আয়নাখানি যদি শরতের নীল আকাশের মতো স্বচ্ছতা দিয়ে কানায় কানায় পূর্ণ করতে পারতাম। পারতাম যদি শরতের মতো শুভ্রতা দিয়ে নিজের ভিতর-বাহির মুড়িয়ে রাখতে কতই না ভালো হতো। প্রকৃতির স্বচ্ছতায় মুগ্ধ হয়ে বান্দা যেন মনের স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে চায়, এ জন্যই আল্লাহতায়ালা অসংখ্য নিদর্শন ছড়িয়ে রেখেছেন মানবগ্রহের পরতে পরতে। তাই তো আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন, বান্দা! চোখ মেলে দেখ আমার সৃষ্টি নৈপুণ্য। সাতটি স্তরে সাজানো আকাশ। আকাশ থেকে পানি মনোহর দৃশ্য। পানি থেকে প্রাণের সৃষ্টি, বৃক্ষের সবুজ হয়ে ওঠা। নব যৌবনে প্রকৃতি কন্যার সেজে ওঠা। এসবই আমি সৃষ্টি করেছি তোমার জন্য।

ঘুমন্ত বিবেকটিকে জাগিয়ে একবার চারপাশে ভাবুক মনটি নিয়ে তাকাও। সৃষ্টি রাজ্যের রহস্য ধরা দেবে তোমার চোখে। ‘যারা এভাবে ভাবুক মনটি নিয়ে আমার সৃষ্টিরাজির প্রতি দৃষ্টি বুলায় তাদের জন্যই রয়েছে চিন্তার খোরাক। চিন্তা-সমুদ্রে ডুব দিয়ে তারা বলে ওঠে, রাব্বানা মা খালাকতা হাজা বাতিলা— ওগো প্রেমময় খোদা আমার! আপনি কোনো কিছুই অযথা সৃষ্টি করেননি। সুবহানাকা ফাকিনা আজাবান নার। হে আল্লাহ! অনর্থক কাজ-কারবার থেকে আপনি কতই না পবিত্র। দয়া করে আমাদের জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচিয়ে সুশোভিত-নয়নাভিরাম জান্নাতে জায়গা করে দিন।’ (সূরা আলে ইরান : ১৯০-১৯১)। বলছিলাম, শরতের শুভ্রতা দেখে বান্দার মনেও সাধ জাগে আত্মার শুভ্রতা ফিরে পেতে। এ চাওয়া মানুষের শেকড়ের চাওয়া। কারণ, জন্মের সময় যে আত্মায় শরতের শুভ্রতা-স্বচ্ছতা নিয়েই জন্মেছে সে। নূরনবী (সা.) বলেছেন, ‘মানুষ যখন জন্মগ্রহণ করে, তখন সে একটি স্বচ্ছ আত্মা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যখন সে গুনাহ করে তখন ওই আত্মায় একটি কালো দাগ পড়ে। এভাবে যখন সে গুনাহর জীবনযাপন করতে থাকে তখন তার আত্মা কুচকুচে কালো হয়ে যায়। যেন মেঘে ঢাকা কালো আকাশ। বান্দা যখন তওবা করে, সঙ্গে সঙ্গে তার মনের আকাশের কালো মেঘটি সরে যায়। আত্মা হয়ে ওঠে শরতের স্নিগ্ধ-স্বচ্ছ আকাশের মতো কাশফুলের মতো সাদা, মেঘের মতো নরম, ধানের ডগার মতো সোনালি। এক কথায় তওবার বৃষ্টিতে ভিজে বান্দা শরতের প্রকৃতির মতোই ঝকঝকে তকতকে হয়ে ওঠে। তখন তাকে দেখা মাত্রই আল্লাহর কথা স্মরণ হয়। এ ধরনের মানুষকেই হাদিসের পরিভাষায় অলিউল্লাহ-আল্লাহর অলি বলা হয়েছে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ)।

শরৎ আসে শরৎ যায়। আমাদের মনকে কি নাড়া দেয় শরৎ মৌসুম? শরতের প্রকৃতির মতো শুভ্রতার সাজে সাজতে কি ইচ্ছা হয়? সবার হয় না। এর কারণ হলো, আমরা ভাবুক মন নিয়ে চিন্তার চোখ দিয়ে শরেক দেখি না, প্রকৃতিকে দেখি না। তাই তো প্রকৃতির নীরব ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা আল্লাহর মাহবুব বান্দাও হতে পারি না। তাই আসুন! মনের চোখ মেলে চারপাশ দেখি, চিন্তা সাগরে ডুব দিয়ে খোদার সৃষ্টিরাজি নিয়ে ভাবি। তবেই আমাদের জীবন হয়ে উঠবে প্রকৃতির মতো রঙিন, সবুজমাখা বৈচিত্র্যময়। আল্লাহ আমাদের এ শরতে বেহেশতি রঙে রাঙিয়ে দিন।

লেখক : বিশিষ্ট মুফাসসিরে কোরআন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।

www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর