যদি কোটা সংস্কার করতে গিয়ে কাউকে লাথি মারতে হয়, তাহলে নারীকে লাথি মারলে সবচেয়ে সুবিধা। নারী তো অবলা, কিছু বলবে না। ইতিহাসের শুরু থেকে মুখ বুজে নির্যাতন সইছে কে? নারী। নারীকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্বনির্ভরতা এবং স্বাধীনতা থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বঞ্চিত করা হয়েছে, এবং এখনো হচ্ছে। হচ্ছে নারীর লিঙ্গদোষের কারণে। নারীর লিঙ্গ পারফেক্ট নয়, নারীর লিঙ্গ অসম্পূর্ণ। পুরুষেরা নানা রকম কমেডি করেছে এই লিঙ্গ নিয়ে। বাংলাদেশের কোটা সংস্কার আন্দোলনে নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস করার লোক প্রায় ছিলই না বলতে গেলে। ধর্মান্ধ লোকের আধিক্য ছিল দৃষ্টিকটু-রকম। তারা তো নিশ্চয়ই কেউ চায়নি নারী কোটা। এমনকী কিছু মগজধোলাই হওয়া পুরুষতন্ত্রবিশ্বাসী নারীও নারী কোটার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়েছে।
মিনিমাম এক শ লোক না মরলে, মিনিমাম এক শ কোটি টাকার গাড়ি বাড়ি পাবলিক প্রোপার্টি আগুনে না পুড়লে সরকার কারও কোনো দাবি মেনে নেয় না। এখন কী নারীরা তাদের প্রাপ্য সংরক্ষণের জন্য রাস্তায় নেমে বুক পেতে দাঁড়াবে নিহত হওয়ার জন্য? অবিবেচকের মতো গাড়িবাড়ি পাবলিক প্রোপার্টি পোড়াবে? তাহলে কী পুনর্বিবেচনা করা হবে সংরক্ষণ সংস্কার? তার চেয়ে ভালো সরকার বসুক নারীবাদীদের সঙ্গে আলোচনায়। নারীবাদীরা বলুক কেন সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য নারীর সংরক্ষণ জরুরি। নারীকে হাজার বছর ধরে বঞ্চিত করেছে নারীবিদ্বেষী পুরুষতন্ত্র। পাপ মোচনের জন্য হলেও তো সমাজকে গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে নারীর জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। সংরক্ষণ না হলে নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা পিছিয়ে পড়বে আর নারীর সমানাধিকারের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। অসভ্য সমাজের জন্য নারীর সমানাধিকার না থাকা চমৎকার বটে, কিন্তু সভ্য সমাজের জন্য একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
বাংলাদেশে নারী পুরুষের মধ্যে যে বৈষম্য, তা কমার বদলে বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বিশ্বের জেন্ডার গ্যাপ জরিপে দেখিয়েছে ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্থান ছিল ১৪৬টি দেশের মধ্যে ৬৫তম, ২০২২ সালে ছিল ৭১তম, ২০২৩ সালে জানি না কী কারণে হয়েছিল ৫৯তম আর ২০২৪ সালে পিছিয়ে হয়েছে ৯৯তম। তাহলে কী এভাবে আরও পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশ? পেছনের আফগানিস্তান বা সুদানের (১৪৬তম) দিকে তাকিয়ে খুশিতে নৃত্য করার বদলে আইসল্যান্ডের (প্রথম) দিকে তাকিয়ে জেন্ডার গ্যাপ সম্পূর্ণ জিরো করে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে। মনে রাখতে হবে, পেছনে যাওয়াটা সহজ, সামনে এগোনোটা কঠিন। কঠিন কাজটি করার মধ্যেই আছে চ্যালেঞ্জ। কঠিন কাজের মধ্যে সবচেয়ে জরুরি, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক সমস্ত আইন কানুন এবং রীতি-নীতিকে চিরকালের বিদেয় করা, নিশ্চিহ্ন করা। জানি মৌলবাদীরা ঝাঁপিয়ে পড়বে, এমনকী বোরখা এবং হিজাব পরিহিত নারীরাও চিৎকার করবে। তারা বলবে তারা চায় না কোনো সংরক্ষণ। তারা নারী বলেই কিন্তু ভেবে নেওয়া উচিত নয় যে, তারা নারীর ভালো চায় বা তারা নারীবাদী। নারীরা নারীর শত্রু হতে পারে, পুরুষরা আবার নারীর শুভাকাক্সক্ষী হতে পারে। এ সম্পূর্ণই নির্ভর করে কে কোন শিক্ষা পেয়ে শৈশব থেকে বড় হয়েছে, কে কোন আদর্শ নিয়ে বেড়ে উঠেছে, কার মন ও মনন কতটা সমৃদ্ধ। সুতরাং প্রতিটি শিশুর জন্য বিদ্বেষহীন বৈষম্যহীন সুস্থ শিক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি।
মেধা মেধা করে কোটা আন্দোলনকারীরা বেশ চিৎকার করেছে রাস্তাঘাটে। তারা মনে করে মেধার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ দিলেই আর অবিচার হবে না কারও প্রতি। আমার প্রশ্ন, সুফিয়া আক্তার আর সেলিম রহমান যদি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ঠিক একই নম্বর পেয়ে পাস করে, তবে চাকরিটি কাকে দেওয়া হয়? আমরা সবাই জানি দেওয়া হয় সেলিম রহমানকে, কারণ সুফিয়া আক্তারকে নিয়ে সবার সংশয় হয়। সুফিয়া আক্তার বিয়ে করবে, গর্ভবতী হবে, লম্বা ছুটি নেবে, সন্তান প্রসবের জন্য ছুটি নেবে, সন্তানের অসুখ বিসুখে ছুটি নেবে, সন্তানের লালন পালন করতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রে মনোযোগ হারাবে-ইত্যাদি আশঙ্কা করে সুফিয়া আক্তার মেধাবী হলেও চাকরিটি সুফিয়া আক্তার পায় না। তারা সেলিম রহমানকে নির্বাচন করে, কারণ সেলিম রহমান বিয়ে করলেও গর্ভবতী হবে না, সন্তান প্রসবের জন্য, সন্তান লালন-পালনের জন্য তাকে ছুটি নিতে হবে না। সুতরাং সেলিম রহমান চাকরির জন্য ফিট, সুফিয়া আক্তার ফিট নয়। যুগের পর যুগ এভাবেই নারী এবং পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করেছে সমাজ। যুগের পর যুগ এভাবেই মেধাবী নারীকে নিয়োগের ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেছে নারীবিরোধী সমাজ।
এটিই সমাজের বাস্তব চিত্র। নারীর মেধা পুরুষের চেয়ে বেশি হলেও চাকরি পুরুষেরা পায়। সভ্য দেশগুলোয় সন্তান লালন-পালনের দায়িত্ব সমানভাবে মা এবং বাবা উভয়ের। সে কারণে মা এবং বাবা দুজনেই মেটারনিটি লিভ আর প্যাটারনিটি লিভ সমান সময়ের জন্য পান, একজন ছ’মাস পেলে আরেকজনও ছ’মাস পান। কিন্তু যে সব দেশে মনে করা হয় সন্তান লালন-পালন নারীর কাজ, ঘর-সংসার সামলানো নারীর কাজ, সেসব দেশে নারী চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। সুযোগটা পেয়ে যায় পুরুষ। সে কারণেই বলছি কর্মজীবী নারীরা আজকাল একাধিক সন্তান কমই নিচ্ছে, তাদের যেন বঞ্চিত না করা হয়। নারীকে সন্তান পালনের ভার একা না দিয়ে সামাজিক ব্যবস্থা এমনই করা উচিত যে পিতাও সন্তান লালন-পালন করবে, সুতরাং বাধ্যতামূলক পিতৃত্বের ছুটি পুরুষকেও নিতে হবে। তাছাড়া ডে-কেয়ারের সংখ্যা বাড়লে, মন্টেসরি, নার্সারি এবং কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা বাড়লে শিশু পালনে অভিভাবকদের সমস্যা হবে না। আজকের শিশুরাই ভবিষ্যতের নাগরিক। যে মানুষ ভবিষ্যতের নাগরিককে জন্ম দিচ্ছে, তাকে যদি অর্থনৈতিকভাবে পরনির্ভর করে রাখার ব্যবস্থা হয়, তবে, ভবিষ্যৎ নাগরিক কিন্তু নারী পুরুষের মধ্যে কোনো সমতা দেখতে পাবে না। তাকে দেখতে হবে স্বনির্ভর আর পরনির্ভর, প্রভু আর দাসী, ক্ষমতাবান আর ক্ষমতাহীনের বৈষম্য। দেখে দেখে সেও বৈষম্য শিখবে, সেও নারীকে হেলা করতে আর হেয় করতে শিখবে। সুতরাং সুস্থ এবং শিক্ষিত নাগরিক তৈরির জন্য হাউসওয়াইফ নয়, কর্মজীবী নারীর প্রয়োজন। আর সেটার জন্য অবশ্যই নারী কোটার প্রয়োজন। কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে থাকা নারীকে এই শুরু হলো কিছু কোটার ব্যবস্থা করে সামনে এগিয়ে দেওয়া। এটুকুও যদি বন্ধ হয়ে যায়, তবে সংসদে বসা নারী মন্ত্রীদের ধিক্কার জানাবে আগামী প্রজন্ম। কী করেছে তারা জনসংখ্যার অর্ধেক নাগরিক নারীর জন্য?
নারী কোটার প্রশ্ন উঠত না যদি পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলে পৃথিবীতে কিছু না থাকত, যদি নারীকে দাবিয়ে রাখা, নারীকে শিক্ষা এবং স্বনির্ভরতা থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র না থাকত, যদি নারীকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়ায় বাধা না দেওয়া হতো, যদি নারীকে মেধাহীন বলে ভাবা না হতো, যদি নারীকে অযোগ্য আর অপদার্থ বলে দেখা না হতো, যদি নারীবিদ্বেষী আর নারীবিরোধীতে সমাজ ছেয়ে না থাকত।
বাংলাদেশে পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকের সংখ্যা অর্ধেক, পুরুষ পেশাজীবীর চেয়ে নারী পেশাজীবীর সংখ্যা অর্ধেকের চেয়ে কম, পুরুষ ব্যবসায়ীর চেয়ে নারী ব্যবসায়ীর সংখ্যা অতি সামান্য, মাত্র ৭.২%। বেকার পুরুষের চেয়ে নারী বেকারের সংখ্যা নিশ্চয়ই হিসাবের বাইরে, কল্পনার বাইরে। নারীকে বেকার করে রাখলে, তাদের মেধাকে ব্যবহার না করলে, সমাজ এবং রাষ্ট্র বরং নারী যত বঞ্চিত, তার চেয়ে বেশি বঞ্চিত হবে। নারী যদি উপার্জন করে, তাহলে পরিবার সমৃদ্ধ হয়, সমাজ সমৃদ্ধ হয়, রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। জনসংখ্যার অর্ধেককে ঘরে বসিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রের অবসান হোক। দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, তিনিই যদি দেশের বিপুলসংখ্যক নারীকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে না আসেন, যদি পরাধীনতা আর পরনির্ভরতার শৃঙ্খল থেকে তাদের মুক্ত না করেন, তাহলে শুধু আজকের নারীর নয়, আগামীর নারীর দুরবস্থার জন্য তিনি দায়ী থাকবেন।
শাসকদের হয়তো কোনো অনুশোচনা হয় না। ভুল শুধরে নেওয়ার আর সময়ও তাদের থাকে না। দেশে যে হারে মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, আশঙ্কা হয়, একদিন মৌলবাদীরাই হয়তো ক্ষমতায় বসবে, তখন নারীর অবস্থার অবনতি হবে সহস্র গুণ। কালো নিকাবে মুখ ঢেকে ফেলবে নারীরা। অবয়বহীন নামপরিচয়হীন জড়বস্তুর মতো হবে তাদের অস্তিত্ব। তারা ঢুকে যেতে বাধ্য হবে অন্দরমহলে। অন্দরমহল থেকে নির্যাতনের শব্দ ভেসে আসবে, কান্নার শব্দ ভেসে আসবে। নারীদের মুক্তির পথগুলো সব যেহেতু বন্ধ, এই কান্নার আর হাহাকারের শব্দের কোনো শেষ থাকবে না।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা