১. আমরা গণতন্ত্র চাই। কিন্তু নিজ দলেই গণতন্ত্র নেই। ৫৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে আমার পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা হলো- কোনো দলই সুষ্ঠুভাবে দলের মধ্যে রাজনৈতিক চর্চা করে না। দলের মধ্যে প্রতিনিয়ত গণতান্ত্রিক নিয়ম-রীতি, আচরণ এবং রাজনীতি-সংস্কৃতির চর্চা না হলে দেশে ন্যায়ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে না, সম্ভব নয়। বাংলাদেশে প্রাচীনতম দল আওয়ামী লীগ। ঢাকঢোল বাজিয়ে ট্রাককে ট্রাক লোক এনে যে কাউন্সিল হয় সেটা কাউন্সিল থাকে না- হয়ে ওঠে জনসভা। কাউন্সিল ডেকে নেতা নির্বাচন করার কথা। কিন্তু ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত পার্টির নীতি, আদর্শের প্রতি দৃঢ়নিষ্ঠ, সততা ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্য থেকে কাউন্সিল নির্বাচিত হওয়ার কথা, তা হয় না। তারা পার্টির গণতন্ত্র, ম্যানিফেস্টোর ওপর কর্মকৌশল, কর্মপরিকল্পনা আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে জনকল্যাণে অগ্রসর নীতিমালা গ্রহণ করবে। এটাই নিয়ম। সেই নীতিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ, মেধাবী, জনবান্ধব ও সাংগঠনিক কর্মকর্তা নির্বাচন করবেন। পার্টি গঠনতন্ত্রের অনুশীলনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার অঙ্গীকার ঘোষণা করবেন। কিন্তু তা হয় না। পার্টি প্রধান ভাষণ দেন। ভোট হয় না। নতজানু কাউন্সিলরা তার হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়ে চলে যান। দলীয় একনায়কতন্ত্রের জন্ম এভাবে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আমি স্পষ্ট করে বলতে পারি, দেশের দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক চর্চা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অনুশীলন হয় না। এ ধরনের পার্টিগুলো কীভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও তার সুষ্ঠু বন্দোবস্ত করবে? করেনি। করতে পারে না। পারবে না।
২. জনগণ একই মতাদর্শে বা দলে থাকবে বা থাকতে হবে এমনটি নয়। তাই গড়ে ওঠে নানাবিধ দল বা শাখা-সংগঠন। দলগুলোর ক্ষমতায় যেতে জনগণের কাছে যেতে হয়। দলই সরকার গঠন করে। সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করে। সরকার জনস্বার্থে কাজ না করলে দল জনগণের কাছে সমালোচিত হয়। সেজন্য দলের কাজ হলো সরকারকে পাহারা দেওয়া। দলীয় সরকার যেন মানবকল্যাণে রাষ্ট্র পরিচালনা করে, অর্থাৎ দলের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা থাকে। জনগণের কাছে দলের জবাবদিহিতার অপরিহার্যতা রয়েছে। দলকে যেমন নির্দিষ্ট কাঠামো ও নীতিমালার মধ্যে চলতে হয়, সরকারও তেমনি সংবিধান, বিভিন্ন কাঠামো, বিধিবিধান, আইন-কানুনের মধ্যে চলে। দলের নির্বাচনি নীতি মেনেই সরকারকে দেশ চালাতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। ইচ্ছামতো আইন। সংবিধান ভূলুণ্ঠিত।
৩. বলা হয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্র আছে। কেমন গণতন্ত্র? একই ব্যক্তি যিনি দলের প্রধান হন, তিনি পার্লামেন্টারি পার্টির প্রধান, সংসদ নেতা হন এবং একই সঙ্গে সরকারপ্রধান হন। এ অবস্থায় কে কার কাছে জবাবদিহি করবে? দল ও সরকার যখন একাকার, এক ব্যক্তিই যেখানে সর্বক্ষেত্রে প্রধান, সে ক্ষেত্রে একনায়কতন্ত্রের জন্ম হবেই। একনায়কতন্ত্র জনগণের কল্যাণে কাজ করে না। করে বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর জন্য। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ব্যাপক দুর্নীতির জন্ম দেয়।
৪. এখানেই প্রশ্ন চলে আসে দলীয় সংস্কার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামত। বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সংস্কারের অভাবে, গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা তলিয়ে গেছে। সুশাসন নিখোঁজ। গণতন্ত্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিকল্পিতভাবে ছেঁটে ফেলা হয়েছে। জনগণকে অন্ধ, বধির, লুলা ও ল্যাংড়ায় রূপান্তরিত করা হয়েছে। জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, দার্শনিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব পালনে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী ফোরামে কতিপয় সারতত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছিল। প্রস্তাবের সারমর্ম বৈপ্লবিক কিছু নয়, সংস্কারমূলক। যেমন-
ক. আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ট্রেডিশন মোতাবেক কার্যনির্বাহী সভায় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ‘যিনি দলের প্রধান হবেন। তিনি সরকারপ্রধান হবেন না।’ খ. রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ, সংসদ সদস্যগণ প্রতি বছর হলফপূর্বক তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব বাধ্যতামূলক পার্টিতে ও জনসম্মুখে প্রকাশ করবেন। গ. দলের ঊর্ধ্বতন নেতা-কর্মী, অঙ্গসংগঠনের সবাই হলফনামার মাধ্যমে প্রতি অর্থবছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করবেন। ঘ. প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তনে চেয়েছিলাম যিনি প্রধানমন্ত্রী বা নির্বাহী প্রধান হবেন, তিনি দলের প্রধান হবেন না। ঙ. একনাগাড়ে দুবারের অধিক কেউ প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হতে পারবেন না। চ. দলের তহবিলের উৎস প্রকাশ জরুরি। কে অর্থ দিল? কত দিল, তা জানাতে হবে যেন কালো টাকার কালো মানুষগুলো দলে, সংসদে বা সরকারে না ঢুকতে পারে।
৫. এসব প্রস্তাব দেওয়ায়, আমাদের পেছনে গুন্ডা লাগিয়ে দেওয়া হলো। হামলা করা হলো। দলে কোণঠাসা করা হলো। পার্টি-অফিস থেকে বিতাড়িত করা হলো। আমাদের চিহ্নিত করা হলো সংস্কারপন্থি হিসেবে। সাংবাদিকরা আমাকে ২০০৮ সালে প্রশ্ন করেছিলেন, প্রস্তাবিত ওই সংস্কার চাই কি না? বলেছিলাম, ‘আমি সংস্কারে ছিলাম, আছি এবং থাকব।’ চারদিকে প্রচার করা হলো আমরা দলদ্রোহী শুধু নই, রাষ্ট্রদ্রোহী। দেশের ভালো চাওয়া, রাষ্ট্রের মঙ্গল চাওয়া কি অপরাধ, না দেশপ্রেমিকের কাজ? আমরা যেন মূর্তিমান আতঙ্ক! নীতিহীন বন্ধুরা ভীতিকর হিসেবে আমাদের অগ্রাহ্য করলেন। প্রশাসনের মনোভাব একই রূপ।
৬. বাংলাদেশে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি নির্বাচিত হয়েও সরকার গণতান্ত্রিক হয় না। একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরাচার হয়ে থাকে। পরিণতি দাঁড়ায় কর্তৃত্ববাদে। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা দল, সংসদ, সরকার একাকার করে ফেলে। জনগণ বা দলের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে পুলিশ প্রশাসন, আমলাতন্ত্রের কাঁধে চড়ে বসে। সর্বত্র দলীয়করণ রাষ্ট্রযন্ত্রকে গ্রাস করে। সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন তারাই সরকার। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নন। সেবক নন। জনগণকে গোলাম বানিয়ে ছাড়েন। ফলে জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে থাকেন। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের কৌশল সন্ত্রাস আর আতঙ্ক দ্বারা জনগণকে পদানত করেন। এর নির্দয় ব্যবহারে জনগণের অধিকার ভয়ের কাছে পদানত হয়। ব্যক্তি-সামাজিক স্বাধীনতা উধাও হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে যায়।
৭. স্বৈরাচারী সরকার প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ভিত্তি ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল বা ধ্বংস করে। যার মধ্যে রয়েছে সংবিধান, নির্বাচন, সংসদ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার। ক. কর্তৃত্ববাদী সরকার নির্বাচন কমিশনে দৃশ্য ও অদৃশ্য প্রভাব বিস্তার করে, যার লক্ষ্য শাসক দলের নির্বাচনে নিশ্চিত বিজয়। খ. প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ, যার মাধ্যমে বিরোধী পক্ষগুলো ভোটের লড়াইয়ে বাধা প্রদানকারী শক্তির মোকাবিলা না করতে পারে। সরকারি দলের গুন্ডাবাহিনী ও পুলিশ একযোগে প্রতিপক্ষকে হামলা করে। শাখা দলকে আদর্শিকভাবে গড়ে না তুলে ক্ষমতার লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিগত দলীয় নির্বাচনে দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কর্তৃত্ববাদী শাসকের পতন হলে আমরা দেখতে পাচ্ছি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো, আর্থিক খাত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কী নিদারুণ দলীয়করণ। ভূমি, হাট-ঘাট, নদী, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান সবকিছু দখল করেছিল পতিত শাসকের তল্পিবাহকরা।
৮. দলীয় ব্যবস্থার শর্ত হলো নির্বাচিত ও প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা ও তদারকি করা। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর ব্রিটেনে গৃহীত ম্যাগনাকার্টা বলে দেয়, জনগণ দেশের মালিক- তারা দেশ শাসন করবে। দেশ শাসন করতে গেলে দল লাগে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে সংসদ গঠিত হবে। সরকার রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রদত্ত ম্যান্ডেট অনুযায়ী অঙ্গীকার পালন করবে। রাজনৈতিক দল গণম্যান্ডেটে সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত নির্বাচনের অধিকার, যা হলো একটি সুরক্ষিত সুযোগ; সেই সুযোগ সব রাজনৈতিক দলের জন্য হতে হবে সবার জন্য সমান। বাংলাদেশে যা ধ্বংস করা হয়েছে।
৯. দলীয় ব্যবস্থার অভাবে রাষ্ট্রের স্থিতিস্থাপকতা থাকে না এবং থাকে না সঠিক আত্মনির্ধারণের ক্ষমতা। এর অভাবে সরকার হয়ে ওঠে অনমনীয় এবং অদমনীয়। সরকার তখন সেবার মনোভাব ত্যাগ করে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় দানবীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে স্বৈরাচারী আধিপত্যের গ্রন্থিহীন ব্যবস্থা। মুক্তচিন্তা, বিবেকের স্বাধীনতা, মৌলিক মানবাধিকার বন্দি থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত যে, কোনো ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসকের আমলে কোনো দেশেই স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় থাকার কোনো উদাহরণ অতীতেও ছিল না, এখনো নেই এবং আগামী দিনেও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ, ফ্যাসিবাদীদের একদলীয় শাসন কায়েম রাখতে বিরোধী মতপথের মানুষের ওপর যে অমানবিক দমনপীড়নের যজ্ঞ চলে, তাতে করে দেশে স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শৃঙ্খলা স্বাভাবিক কারণেই কল্পনা করা যায় না।
১০. দলীয় ব্যবস্থার ভিত্তিমূলে রয়েছে এমন ধারণা যে, ‘মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব।’ মানুষ সরকারের ভিত্তি হিসেবে নীতিকে ক্ষমতা থেকে অনেক শ্রেয় জ্ঞান করে। শক্তি প্রয়োগ থেকে আলোচনা বা সমালোচনাকে অনেক বাঞ্ছনীয় মনে করে। তারা মতবাদের দ্বন্দ্বকে অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে অনেক বেশি সৃষ্টিধর্মী মনে করে। দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে- প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু শত্রুতা নয়। এই পরিবেশ ও পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতা পরাভূত হয়। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন জনগণের এই আত্মশক্তিকে জাগরিত করেছে। বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। সেই বিজয় ধরে রাখতে হলে, এগিয়ে নিতে হলে সংস্কার যেমন জরুরি তেমনি সংস্কারের অগ্রগতির চলমান ধারাকে অক্ষুণ্ণ ও জীবন্ত রাখতে ভ্যানগার্ড হিসেবে পাহারা দিতে হবে ছাত্র-জনতাকে।
১১. বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আজ প্রয়োজন রাষ্ট্র-সংস্কারের ক্ষেত্রে জরুরিভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নেওয়া। সবার সম্মতিতে সংস্কারের প্রারম্ভিক গতিধারা যাতে সুষ্ঠুভাবে ও নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারে তার জন্য প্রয়োজন সব দলের সম্মতিতে রাজনৈতিক সংস্কারের জাতীয় সনদ। যা হবে রাজনৈতিক দলের জন্য বাধ্যতামূলক।
♦ লেখক : মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ১৯৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী