৫ আগস্ট হাসিনা স্বৈরাচারী সরকারের পতনের তিন দিন পর ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে হিসাবে ৮ সেপ্টেম্বর ছিল এ সরকারের মাসপূর্তি দিবস। এক মাস আর এমন কি সময় যাতে একটা সরকারকে মূল্যায়ন করা যাবে! তারপরেও বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে দিনটিকে কেন্দ্র করে। একটি দল একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যার শিরোনাম ছিল- ‘কী হতে পারত’। পত্রিকাগুলো ক্রোড়পত্র করেনি, কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রথম পৃষ্ঠায় নিউজ করেছে। টেলিভিশনগুলোরও কাছাকাছি অবস্থা।
অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ওইদিন সকালে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রতিনিধি, ছাত্র সংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন ডক্টর ইউনূস। স্বপ্ন পূরণের আগে শিক্ষার্থীদের দমে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। খুবই উদ্দীপক একটা বক্তব্য। গত ১৫ বছরের অপশাসনের কথা স্মরণ করে তিনি আরও বলেছেন, এতদিন তারা চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নের মধ্যে ছিল এবং আনন্দ সহকারে লুটপাট করে যাচ্ছিল। এরা কি এখন চুপচাপ বসে থাকবে? না, তারা আবার তোমাদের দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না। কাজেই যে কাজ তোমরা শুরু করেছ তা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এর থেকে বেরিয়ে যেও না। এটাও একটা উৎসাহব্যঞ্জক বক্তব্য। কিন্তু খোদ প্রধান উপদেষ্টা যখন এরকম কথা বলেন তখন তার তাৎপর্য আরও গভীর হতে পারে। হতে পারে, গভীর ষড়যন্ত্র চলছে যাতে অন্তর্বর্তী সরকার চিন্তিত। এবং সেজন্য তিনি শিক্ষার্থীদের সতর্ক ও প্রস্তুত থাকতে বলছেন? সত্যি কি তাই? পরিস্থিতি কি এতই গম্ভীর যার জন্য শিক্ষার্থীদের দমে যেতে নিষেধ করছেন তিনি? এবং বলছেন যতদিন কাজ শেষ না হবে ততদিন এর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাবে না? সেই আলোচনা পরবর্তীতে কোনো এক সংখ্যায় করব। আপাতত আমি মাসপূর্তি দিবসের মধ্যেই থাকতে চাই। কারণ এ দিবসে সরকারে আছেন বা সরকারের সঙ্গে একভাবে যুক্ত আছেন তারা অনেক কথা বলেছেন যা ভাববার মতো।
বিশেষ করে নতুন সরকারের মাসপূর্তি নিয়ে শিক্ষার্থীদের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো। অবশ্য তারা মাসপূর্তির কোনো অনুষ্ঠান করেননি। নিজের নিজের মতো করে অথবা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন জায়গায় অন্তত চারটি বড় বড় অথবা বিশাল বিশাল সমাবেশ করেছেন তারা। প্রথম সমাবেশটির কথা উল্লেখ করব, সেটা হয়েছে ঢাকার জাতীয় শহীদ মিনারে। সমাবেশ থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শক্তিকে সংহত করে দেশ পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নাগরিক কমিটি নামে সংগঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে এ কমিটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সফল করার লক্ষ্যে কাজ করবে। অনেকে যদিও মনে করছেন দিন শেষে এটা একটা রাজনৈতিক দলের রূপ নেবে (এরকম কথা তাদের পক্ষ থেকে আগে বলা হয়েছিল) কিন্তু তারা সেটা বলছেন না। তারা বলছেন, আমরা কোনো ব্যক্তি বা দলীয় এজেন্ডা সামনে আনছি না, আমরা বাংলাদেশকে সামনে রাখছি।
নতুন ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, তারা দল গঠনের কাজে নামেননি, রাষ্ট্র গঠনে নেমেছেন। সেখানে যদি কোনো দলের পুনর্গঠনের প্রয়োজন হয়, সেটা হবে। জাতীয় শহীদ মিনারে আয়োজিত জাতীয় নাগরিক কমিটির এ সভায় আটটি কাজের কথা তুলে ধরা হয়, যার শেষটিতে আছে : গণপরিষদ গঠন করে গণভোটের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান তৈরির জন্য গণআলোচনার আয়োজন করা। বেশ বড় মাপের কথা। সংবিধান সংশোধন, নাকি পুনর্লিখন, নাকি একটি গণপরিষদ গঠন করে নতুন একটি সংবিধান রচনা- এ নিয়ে দেশে ইতোমধ্যে জোর বিতর্ক তৈরি হয়েছে। নব ঘোষিত সংগঠন অবশ্য নতুন সংবিধানের পক্ষেই বলছেন তা না। তারা এ জন্য গণআলোচনার আয়োজন করতে চান। অভিপ্রায় নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু এ আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। তাদের সঙ্গে থাকতে হবে একদল সংবিধান বিশেষজ্ঞ। শেষ পর্যন্ত একটা সিদ্ধান্ত তো হতে হবে এবং সেটা হওয়া উচিত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে। এটা কেবল আমরা চাই বলেই হবে না, সবাই মিলে চাইতে হবে। সেই ঐকমত্য তৈরি একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া।
মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ মাঠে ছাত্র-জনতার সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন চমৎকার কথা। আপনাদের মনে থাকার কথা ছাত্র-জনতার, এ ইতিহাস সৃষ্টিকারী গণ অভ্যুত্থানের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও hate politics নামে একটি জোরদার ক্যাম্পেইন চলেছিল। সারজিস আলম সেখানে বলছেন, ভালো মানুষগুলো যদি রাজনীতিতে না যায় তাহলে খারাপ মানুষের দ্বারা আপনাকে শাসিত হতে হবে। আপনি যদি চান যোগ্য মানুষগুলো, মেধাবী মানুষগুলো দেশের কার্যক্রম পরিচালনায় যাক তাহলে হয় আপনাকে রাজনীতিতে যোগ দিতে হবে, না হয় আপনাকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে হবে।
সারজিস আরও কিছু কথা বলেছেন যা রীতিমতো প্রণিধানযোগ্য। আন্দোলন কীভাবে সফল হয়েছিল সেই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১৬ বছর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্নভাবে সরকার পতনের চেষ্টা করেছিল। তারা সরকারের একটি খুঁটিও টলাতে পারেনি। মেধাবী ছাত্র-জনতা যখন রাজপথে নেমেছে, একটি গ্রুপ তত্ত্বীয় পড়াশোনা করেছে; বাস্তব ইতিহাস ঘেঁটেছে, এগুলোর সঙ্গে রিলেট করে কর্মসূচি দিয়েছে, তখন আমাদের আন্দোলন সফল হয়েছে।
শুনে ভালো লাগল যে, যারা এ ছাত্র গণ আন্দোলনের শেষে এসে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা তত্ত্বীয় লেখাপড়া করেছেন। তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের সম্পর্ক স্থাপন করেছেন বা করতে পেরেছেন, তাই তারা জিতেছেন। বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বা যারা এ আন্দোলন করেছেন তাদের সবাই তো আর তাত্ত্বিক হননি। সবাই আসলে তাত্ত্বিক হতে পারেও না। নেতৃত্ব যদি পারে তাহলে সেটা খুবই বড় কথা। স্বাধীনতার এ ৫৪ বছরে বাংলাদেশ মেধাবী নেতৃত্বের দেখা তো তেমন পায়নি। কিন্তু সারজিস এটা কী বললেন গত ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সরকারের একটি খুঁটিও টলাতে পারেনি! এ কথা দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো যে আন্দোলনের ভিত্তি তৈরি করেছে, অনেক ঐতিহ্যিক একটি দল আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকে জনপ্রিয়তার দিক থেকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলেছে তা সব অস্বীকার করা হয়ে যায় না?
এক দোর্দণ্ড প্রতাপশালী, রক্তপিপাসু, খুবই হৃদয়হীন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শিক্ষার্থীরা যে অনন্য সাধারণ ইতিহাস তৈরি করেছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এ অধ্যায় এক দিনে রচিত হয়নি। ১৫ বছরের নিষ্ঠুর, স্বৈরাচারী শাসন, তার বিরুদ্ধে জনগণের নিরন্তর লড়াই, স্বৈরাচারকে জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। মানুষ যে কোনো মূল্যে এর পতন চাচ্ছিল। আর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ লড়াই গড়ে তুলতে বিরতিহীন, লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো। তার জন্য অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে দলের নেতা-কর্মীদের, কারাবরণ করেছেন দীর্ঘ সময়; জীবন দিয়েছেন অনেকে। ফ্যাসিবাদ পতনের তাত্ত্বিক ও বাস্তব জমি তো তারাই তৈরি করেছেন। এ কথা অবশ্য ঠিক শেষ লড়াইটা তারা করতে পারেননি। তার একটা কারণ অবশ্য এই যে, প্রয়োজনের সময় তারা চ্যালেঞ্জ দিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু এও তো ঠিক যে সরকার যেভাবে তাদের ওপরে সদা খড়গহস্ত ছিল শিক্ষার্থীদের বেলায় শুরু থেকে তারা তা ছিল না। ফ্যাসিবাদী সরকার বুঝতেই পারেনি এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত তাদের পতনের ঘণ্টা বাজাবে। না হলে শেখ হাসিনা খামখেয়ালিপনা করে, অহংকার করে কোটা আবার চালু করার দম্ভ না দেখালে আন্দোলন মাঠে গড়াতে কত সময় নিত তা ভেবে দেখার বিষয়। তার ওপরে আবার রাগ দেখিয়ে বাচাল প্রধানমন্ত্রী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে সম্বোধন না করলে পরিস্থিতি তখনই পেকে উঠত কি না তাও ভাববার বিষয়। আর এসবই হলো রাজনীতির মিথস্ক্রিয়ার ফসল। রাজনীতি হলো সমাজের কর্ণধার, সবচেয়ে বড় শিক্ষক।
লেখক : সভাপতি, নাগরিক ঐক্য