সহজ সরল পথই ইসলামের পথ। ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা যার মধ্যে কোনো জটিলতা নেই। মানবতার আদর্শে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এ জীবনব্যবস্থায় প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অন্যের অধিকারের প্রতি সম্মান দেওয়া হয়। সব ক্ষেত্রে সহজ-সরল জীবনের শিক্ষা দেয় ইসলাম। যে জীবন হবে পবিত্র। রসুল (সা.)-কে এক্ষেত্রে আদর্শ হিসেবে অনুসরণ করতে হবে। নবীজি সরলতাকে ইমানের অংশ বলেছেন। তিনি অনুসারীদের সহজ-সরল জীবনযাপনের শিক্ষা দিয়েছেন। আবু উমামা (রা.) বর্ণিত হাদিসে মহানবী ইরশাদ করেছেন, ‘নিঃসন্দেহে সরলতা ইমানের অংশ।’ ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী আদম ও হাওয়া থেকে সব মানুষের সৃষ্টি। যে কারণে এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে ইসলাম গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলাম মনে করে প্রতিটি মানুষেরই উচিত অন্য মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। এমনকি যারা খাদেম তাদের সঙ্গেও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা। নবীজি নিজেও তাঁর খাদেমদের সঙ্গে দরদি আচরণ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবীজি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের খাদেমকে সঙ্গে নিয়ে আহার করে, গাধার পিঠে আরোহণ করে, বাজারে যায় এবং বাঁধে ও তার দুধ দোহন করে সে অহংকারী নয়।’ ইসলাম প্রতিটি মানুষকে স্বাবলম্বী হওয়ার তাগিদ দিয়েছে। নিজের কাজ নিজে করা উত্তম এ শিক্ষা দিয়েছেন নবীজি এবং তাঁর সাহাবিরা। এমনকি নবীজির প্রিয় জামাতা এবং ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) নিজের সাংসারিক কাজের এক বড় অংশ নিজে করতেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকার সময়ও হজরত আলী আগের তিন খলিফার মতো অতি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। সালেহ (রা.)-এর দাদি বলেন, ‘আমি দেখলাম আলী এক দিরহামের বিনিময়ে কিছু খেজুর কিনলেন এবং তা চাদরে পেঁচিয়ে নিজেই বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাকে বললাম (অথবা অন্য কেউ তাকে বলল), হে আমিরুল মুমিনিন! বোঝাটি আমাকে বহন করতে দিন। তিনি বলেন, না, সন্তানদের পিতাই বোঝা বহনের অধিক উপযুক্ত’ (আদাবুল মুফরাদ)।
নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো গ্লানি নেই। বরং প্রতিটি মানুষের উচিত সব ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী হওয়ার দৃষ্টান্ত রাখা। রসুলুল্লাহ (সা.) শত ব্যস্ততার মধ্যেও সাংসারিক বিভিন্ন কাজে পরিবারের সদস্যদের সহায়তা করতেন। তিনি নিজে ব্যবসা করতেন। সামাজিক কাজেও কায়িক শ্রম দিয়েছেন। মহিলা তাবিয়ি আমরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হলো, রসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর বাড়িতে কী কী কাজ করতেন? তিনি বললেন, তিনিও একজন মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর কাপড়ে আটকে যাওয়া চোরাকাঁটা বাছতেন এবং বকরির দুধ দোহন করতেন (আদাবুল মুফরাদ)। রসুল (সা.)-এর কন্যা ফাতেমা (রা.) পরিবারের সব কাজ নিজ হাতে করতেন। তাঁর কোনো দাসী ছিল না। নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো লজ্জা বা অপমানের কিছু নেই। বরং তা মর্যাদাবোধের বিষয়।
মহান আল্লাহতায়ালা কোরআনুল কারিমে সুরা আবাসায় ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর তিনি তার (মানুষ) মৃত্যু ঘটান ও কবরস্থ করেন তাকে।’ (আয়াত ২১)। বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী, মুসলমান-অমুসলমান সবার শেষ ঠাঁই আল্লাহর সৃষ্ট এই মাটিতেই হয়। সব ধর্মীয় মতবিরোধ সত্ত্বেও আল্লাহ রব্বুল আলামিন জগৎসমূহের একমাত্র প্রতিপালক হিসেবে সবাইকে সমানভাবে লালন-পালন করে থাকেন।
বিশ্বাসের বিরোধ থাকা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ সবাইকে একই মেঘের পানি দিয়ে সিঞ্চিত করেন। সবাইকে তাঁর সৃষ্ট সূর্য নিজের রোদ-তাপ সমান তালে দিয়ে থাকেন। একই মাঠে কাদামাটিতে সবাই চাষাবাদ করে সমানভাবে উপকৃত হয়। মহান আল্লাহর দয়া ও কৃপার এই সর্বজনীনতা মানুষকে, বিশেষ করে মুসলমানদের এ শিক্ষা দিচ্ছে, আমরাও যেন আল্লাহর গুণে গুণান্বিত হয়ে সবার জন্য উদারতা প্রদর্শন করি। বিশ্বনবী রসুল (সা.) ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে সম্মান দিয়েছেন। ইসলামের ঘোরতর শত্রু ও কাফেরের লাশকেও তিনি সম্মান প্রদর্শন করেছেন এবং তার উম্মতকেও তা করার নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক নবজাতক ফিতরতের ওপর জন্মগ্রহণ করে। এরপর তার মাতা-পিতা তাকে ইহুদি বা খ্রিস্টান অথবা অগ্নি-উপাসকরূপে রূপান্তরিত করে’ (বুখারি)।
রসুল (সা.) মৃত ব্যক্তির শুধু সম্মান প্রদর্শনই করেননি, বরং মৃতদের গালমন্দ, লাশের অসম্মান, তাদের দোষত্রুটি বর্ণনা করাকে গুনাহের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন। হাদিসে এসেছে- রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মৃতদের গালমন্দ করো না, তারা যা করেছে তারা তা পেয়েছে’ (বুখারি)।
আল্লাহ আমাদের সহজ-সরল জীবনযাপনের তৌফিক দান করুন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক