জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল বলেছিলেন, ‘শিক্ষকরা সাধারণ মানুষ নন, তাই যোগ্যতা ছাড়া শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ কাম্য নয়।’
জার্মানির বিচারক, চিকিৎসক এবং প্রকৌশলীরা যখন সে দেশের সর্বোচ্চ বেতনভোগী শিক্ষকদের সমতুল্য বেতন প্রদানের অনুরোধ জানান, তখন মেরকেল তাঁদের বলেন, ‘যাঁরা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাঁদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’ প্রকৃতপক্ষে আদর্শ শিক্ষকই হলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান। সংগত কারণেই শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার প্রসঙ্গে তাদের যোগ্যতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি সামনে চলে আসে। তাই দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষককে হতে হবে নিয়ত গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। নিজের অর্জিত জ্ঞান-সম্পদকে তিনি সমৃদ্ধতর করে শিক্ষার্থীদের বিতরণ করবেন। তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস শ্রমশীলতা, কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস হবে। কর্তব্য সম্পাদনে তিনি কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন বা নিজের ব্যর্থতার জন্য কোনো অজুহাত সৃষ্টি করেন না। তাঁর দৃঢ় চারিত্রিক গ্রানাইট শিলার বেদিমূলে সস্তা জনপ্রিয়তার কোনো স্থান নেই। তিনি একজন সহজ-সরল, নিরহঙ্কার, সুশিক্ষিত, কর্তব্যনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ, নির্ভীক পণ্ডিত ব্যক্তি। তাঁর পার্থিব চাহিদা সীমিত কিন্তু আত্মার আকাক্সক্ষা সীমাহীন। একজন আদর্শ শিক্ষকের জ্ঞানস্পৃহা ও শিক্ষার্থী প্রীতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে নির্মল জ্যোতিষ্মান আলোকবর্তিকার মতো চিরভাস্বর। সমাজ বা জাতি গঠনে, শিক্ষা সংস্কৃতির উন্নয়নে, সাধারণ জনগোষ্ঠীর ভাগ্য পরিবর্তনে, বিশ্বসভায় জন্মভূমির গৌরবময় অবস্থান সৃষ্টিতে একজন মহান শিক্ষকের অবদান কোনো রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ বা অর্থনীতিবিদের চেয়ে সামান্যও কম নয়।
প্রশ্ন হলো, এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকগণ কতটা যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটা আন্তরিক? এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন। সুন্দর সমাজ, সুন্দর দেশ তথা সুন্দর পৃথিবীর জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অপরিহার্য। আর সে জন্য মেধাসম্পন্ন, যোগ্য শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে যখন নতুন ভাবনা নিয়ে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়, তখন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো)-এর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকদের জন্য একটি ‘সনদ’ প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ঘোষণা করে ‘শিক্ষালাভ মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের হাতিয়ার।’ এরই ফলশ্রুতিতে, ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ (ডাব্লিউসিওটিপি) গঠিত হয়। এরপর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞদের এক সভায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা এবং তার সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকতা পেশার জন্য কী দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কী অধিকার ও মর্যাদা তার জন্য ১৪৬ ধারা-উপধারা বিশিষ্ট একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়। এই ইউনেস্কো/আইএলও-এর সুপারিশকেই ‘শিক্ষক সনদ’ বলা হয়। বিশ্বের ১৭২টি দেশের ২১০টি শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে ওই বছর থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয় এবং বিশ্বের সব দেশে ‘শিক্ষক সনদ’ বাস্তবায়নের আহ্বান জানানো হয়। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। বিশেষ অতিথি ছিলেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা সচিব এরশাদুল হক।
ইউনেস্কো গতিশীল মনের অধিকারী কর্তব্যনিষ্ঠ, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল বিষয় নির্ধারণ করেছে- ‘শিক্ষার জন্য আমাদের শিক্ষক প্রয়োজন : বিশ্বব্যাপী শিক্ষকের অভাব মোকাবিলা করা।’ এই দিবসটি উপযাপনকালে সারা বিশ্বের শিক্ষকগণের মতো আমাদের দেশের শিক্ষকদেরও অতীতের সব অর্জন ও ব্যর্থতার সমীক্ষা করতে হবে এবং সেই সঙ্গে বিশ্বমানের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে।
আমাদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রশ্নে বলতে হয় যে, শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাঙ্গনের ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শিক্ষা উপকরণাদি প্রদান করা হলেও, শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার গুণগতমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা। শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষরূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণার প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার প্রসঙ্গে বলতে হয়, দেশে এ বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। উল্লেখ্য, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯৫ ভাগই পরিচালনা করেন বেসরকারি শিক্ষক। একটি স্বাধীন দেশের জন্য এ অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তান শাসনামলের ধারাবাহিকতায় দেশে সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষক সমাজের দাবির প্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তর জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করতে অতীতের প্রায় সব সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করতে হবে। তবে যতদিন শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা সম্ভব হচ্ছে না, সেই সময়কালে নিম্নে আলোচিত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্বারোপ করা জরুরি।
শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে দেশে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সে কারণে ‘জাতীয় শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করে এক ও অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তেমনি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাঁদের প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। আরও একটি দুঃখজনক বিষয়, এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও সঠিক মূল্যায়ন হয় না এবং পদোন্নতির তেমন সুযোগ নেই। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে প্রশাসন দলীয়করণ হয়, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা থাকে না। আবার শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। যেহেতু সরকার এখন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বেতন স্কেলের প্রারম্ভিকের শতভাগ এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাতার আংশিক প্রদান করছে, তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। প্রশাসনিক সুবিধার্থে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতোই প্রয়োজনীয় বদলি প্রথা প্রবর্তন করতে হবে। সামগ্রিক অবস্থার আলোকে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষকরা চরম হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। ফলে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটার অবকাশ নেই বরং তাঁদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
পরিশেষে বলতে চাই, আর কোনো বঞ্চনা নয়, করুণা নয়, বরং শিক্ষার গুণগতমান বিকাশে শিক্ষকতা পেশার প্রতি ন্যায়বিচার এবং সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে এই প্রত্যাশাই করি।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ ও সাবেক কোষাধ্যক্ষ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়