মুদি দোকানদার আবু সায়েদকে (৪৫) হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে করা হত্যা মামলা মোহাম্মদপুর থানা পুলিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরীর আদালত শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। এদিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
মুদি দোকানদার হত্যা মামলার অন্য আসামিরা হলেন, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ডিএমপির সাবেক কমিশনার ও অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান, ডিআইজি ও ঢাকা মহানগর ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ এবং ঢাকা মহানগর যুগ্ম পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার। এস এম আমীর হামজা (শাতিল) নামে এক ব্যবসায়ী বাদী হয়ে এ মামলার আবেদন করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি রেকর্ড করে আদেশ অপেক্ষমাণ রাখেন। পরে আদালত এ আদেশ দেন।
মামলায় বাদীপক্ষের আইনজীবী হিসেবে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মামুন মিয়া। সংশ্লিষ্ট আদালতের স্টেনোগ্রাফার নূর আলম এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এটাই প্রথম কোনো মামলা। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২, ১৩৪ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত ১৯ জুলাই বিকাল ৪টায় মোহাম্মদপুর থানার বছিলায় ৪০ ফিট চৌরাস্তায় আবু সায়েদ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত হন।
হত্যায় আরও আসামি ওবায়দুল কাদের আসাদুজ্জামান খান, সাবেক আইজিপি মামুন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর ও হারুন-বিপ্লব
মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই বিকাল ৪টায় মোহাম্মদপুর থানাধীন বসিলায় ৪০ ফিট চৌরাস্তায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে মিছিল করছিলেন। সেই আন্দোলন দমনের জন্য পুলিশ নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। সে সময় আবু সায়েদ রাস্তা পার হয়ে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। তার মাথার এক পাশ দিয়ে গুলি ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়।
স্থানীয় লোকজন জানায়, আবু সায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার পর স্থানীয়রা তার লাশ গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার মাড়োয়া বামনহাট ইউনিয়নের নতুন বস্তি প্রধানহাটে পাঠিয়ে দেয় এবং সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। নিহত আবু সায়েদের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে এবং তার পরিবার অত্যন্ত গরিব। তারা আইনের আশ্রয় নিতে পারছেন না। এ কারণে সচেতন নাগরিক হিসাবে এ মামলার আবেদন করেন বলে জানিয়েছেন বাদী।
মামলার আবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ছাত্রজনতার ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি কোটা সংস্কার আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল। কোনো উসকানি ছাড়া আসামিদের নির্দেশে অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্যরা গুলি করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সাবেক সেতুমন্ত্রী আন্দোলন শক্ত হাতে দমন করার নির্দেশ দেন। অন্য আসামিরা ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে তাদের অধীনের পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান পুলিশকে ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি করার নির্দেশ দেন।’ মামলার বাদী এস এম আমীর হামজা (শাতিল) বলেন, আমাকে অনেকেই নিষেধ করেছিলেন। বলছিলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করলে তোমার অনেক ক্ষতি হবে। তবুও আমি বিবেকের তাড়নায় এ মামলা করেছি। আমি শেষ পর্যন্ত লড়ে যাব। এসময় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিও করেন বাদী।
মামলা গ্রহণের আগেই বাদীকে হুমকি : মামলা গ্রহণের বিষয়ে বিচারক আদেশ দেওয়ার আগেই দুপুর সোয়া ২টার দিকে ফ্রান্সের একটি নম্বর থেকে বাদীকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আমীর হামজা বলেন, ‘মামলার আবেদন করেছি। বিচারক কী আদেশ দেবেন, তখনো জানি না। এরই মধ্যে ফ্রান্সের একটি নম্বর থেকে মোবাইল ফোনে আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ফ্রান্সের একটি নম্বর থেকে আমাকে ফোন দিয়ে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করার কনসিকোয়েন্স (পরিণাম) জানি কি না। আমার বাড়ি কোথায়, আমি সেখানে থাকতে পারব কি না; আমি এ মামলায় কোনো টাকা পেয়েছি কি না, আমি এ মামলা নিয়ে শেষ পর্যন্ত কতদূর যাব, গেলে আমি টিকে থাকতে পারব কি না, এসব বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় ওই নম্বর থেকে।’ এ সময় নম্বরটি কার, কোথা থেকে আমার খোঁজ পেল, বিষয়টি তদন্তের দাবি জানান তিনি।
আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার : সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। গতকাল তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মাইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন থানা ও বন্দরে যে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম, সেই ম্যাসেজের ভিত্তিতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, নৌ-পথে পালানোর সময় রাজধানীর সদরঘাট এলাকা থেকে এই দুই প্রভাবশালী নেতাকে নিউমার্কেট থানার মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর মন্ত্রিসভার সদস্যরা আত্মগোপনে রয়েছেন। নেতারাও আত্মগোপনে। কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন বলে খবর আসে। এর মধ্যে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তারের কথা জানাল পুলিশ।
আইনজীবী আনিসুল হক ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা) থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওইবারই তাকে আইনমন্ত্রী করা হয়। এর পর থেকে তিনি আইনমন্ত্রীর পদে ছিলেন।
সালমান এফ রহমান বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সালমান এফ রহমান ঢাকা-১ আসন থেকে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। পরে তাকে নিজের বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেয়।