নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গত ১৫ বছরে ২৫ হাজার অবৈধ গ্যাস-সংযোগে ব্যাপক বাণিজ্য হয়েছে। আর এসব সংযোগ দিয়ে সেখানকার সাবেক এমপি এবং সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী হাতিয়ে নিয়েছেন ১০০ কোটি টাকারও বেশি। প্রায় ৫ বছর আগে এসব দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করে রাখে দুর্র্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) গোয়েন্দারা। এই গ্যাস সংযোগ ছাড়াও গাজীর বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
সাবেক এই মন্ত্রীকে গত শনিবার দিবাগত রাতে রাজধানীর শান্তিনগরের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তারের পর তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তার গ্রেপ্তারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজীর ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ ও কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বিক্ষোভকারীরা এ সময় গাজীর এপিএস এমদাদকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাদের দাবি এপিএস এমদাদকে গ্রেপ্তার করলেই বেরিয়ে আসবে দুর্নীতির আরও তথ্য। এর আগে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নব কিশলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়া (১৭) হত্যাকান্ডে র ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, গোলাম দস্তগীর গাজী, গোলাম মর্তুজা পাপ্পাসহ ৪৫ জনকে নামীয় ও অজ্ঞাত ৬০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। গত ২১ আগস্ট নিহত স্কুলছাত্রের খালা রিনা বাদী হয়ে রূপগঞ্জ থানায় মামলাটি করেন। দুদক সূত্র জানিয়েছে, গোলাম দস্তগীর গাজীর দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সংস্থাটির দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের পরিচালক উত্তম কুমার ম লের সই করা এক চিঠিতে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়েছে।
ওই চিঠিতে বলা হয়, গোলাম দস্তগীর গাজীর বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আছে। এ ছাড়া তার পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, গত সরকারের আমলে অন্তত ২০ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর আয় বেড়েছে নজিরবিহীনভাবে। এর মধ্যে সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সম্পদের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৫ কোটি ৭৭ লাখ টাকার। গত ১৫ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে ২৫ গুণ। সম্পদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১৫ বছরে ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ২১ গুণ। এই সময়ে তার স্ত্রী হাসিনা গাজীর অস্থাবর সম্পদ ২ কোটি ১৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা হয়েছে। ৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকার স্থাবর সম্পত্তি বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ। হাসিনার কাছে থাকা স্বর্ণালংকারের দাম দেখানো হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকার বেশি।
সূত্র জানায়, গাজী ও তার পরিবারের সদস্যরা অবৈধ গ্যাস সংযোগ বাবদ সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে ৩৫ হাজার টাকা নিতেন। আর পাইপ ও অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে আরও নিতেন ১৫ হাজার টাকা। রূপগঞ্জ উপজেলার ভোলাব, ভুলতা, রূপগঞ্জ, কায়েতপাড়া, গোলাকান্দাইল, দাউদপুর ও মুড়াপাড়া ইউনিয়ন এবং দুই পৌরসভা কাঞ্চন ও তারাবোয় এভাবে অবৈধ গ্যাস সংযোগের বাণিজ্য হতো। এ ছাড়া অস্ত্রবাজি, মাদক, সন্ত্রাস, হত্যা, খুন, গুম, জবরদখল সবই হতো গাজীর ইশারায়। এমনকি রূপগঞ্জের প্রতিটি বালুর দানার হিসাবও গাজীর বাড়িতে হতো।
অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ নিরীহ মানুষের আবাদি জমিতে গাজী স্টেডিয়ামের সাইন বোর্ড বসিয়ে বালু ভরাট করে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়েছে। কোথাও আবার আবাদি জমি ও বসতভিটা দখল করে গাজী গ্রুপের বিভিন্ন কারখানা নির্মাণ করা হয়েছে। রূপগঞ্জের কেয়ারিয়া, পর্শি, বাড়িয়াছনি, কুমারপাড়া এলাকায় ৮০ শতাংশ হিন্দু মানুষের জমি জিপার্ক (গাজীপার্ক) নামে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করে বালু ভরাট করে রেখেছে। সূত্র জানায়, রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় বড় জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরি। ফ্যাক্টরির প্রায় ৮০ ভাগ জমিই জোরপূর্বক দখল করা হয়েছে। আয়েত আলী ভূঁইয়ার পুত্র হাজী আমজাদ আলী ভূঁইয়ার ১৯ বিঘা ৮ শতাংশ, হাজী আবদুল হাইয়ের ৪ বিঘা, মোবারক হোসেনের দেড় বিঘা, আবদুল বারী ভূঁইয়ার ২ বিঘা, নূর মোহাম্মদের ১ বিঘা, ইসমাইল খাঁর ৪ বিঘা, সিরাজ খাঁর ৪ থেকে ৫ বিঘা, শাহ আলমের প্রায় ৭০ শতাংশ, জুলহাস ভূঁইয়ার ৭১ শতাংশ ও আপেল মাহমুদের আড়াই বিঘা জমি জোরপূর্বক দখল করে টায়ার ফ্যাক্টরি তৈরি করা হয়েছে। এদিকে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুকে গাজী সেতু, সড়ককে গাজী সড়ক, কালবার্টকে গাজী কালবার্ট, স্কুলকে বীরপ্রতীক গাজী হাইস্কুল, পূর্বাচল উপশহরের মুক্তিযোদ্ধা চত্বরকে গাজী চত্বর, ন্যাংটা মাজার এলাকাকে গাজী এভিনিউ, গাজী স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন স্থানে শুধু গাজীর নামে নামকরণ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে পর পর চারবার এমপি হয়েছেন গোলাম দস্তগীর গাজী। শনিবার রাত পৌনে ৩টায় রাজধানীর শান্তিনগর থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গাজীর ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ, কুশপুত্তলিকাদাহ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গ্রেপ্তার সাবেক পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভ ও কুশপুত্তলিকাদাহ করেছেন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। গতকাল দুপুরে উপজেলার ভুলতা-গোলাকান্দাইল এলাকার ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে এ কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন এলাকায় বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন।
বিক্ষোভ শেষে সংক্ষিপ্ত সভায় বিএনপি নেতা আবদুল আজিজ মাস্টারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন রূপগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সহসভাপতি আনোয়ার সাদাত সায়েম, আশরাফুল হক রিপন, আব্বাস উদ্দিন ভূঁইয়া, জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নাহিদ হাসান, বিএনপি নেতা হাজী আবদুল মতিন, আবদুল জলিল, ছাত্রদল নেতা মাসুম বিল্লাহ, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুজ্জামান ইমন, শাকিল আহমেদ নুরু, ওমর আলী, আরিফ হোসেন, সোলেমান হোসেন, হাকিমুল প্রমুখ। বক্তারা বলেন, গোলাম দস্তগীর গাজী মন্ত্রী ও এমপি থাকাকালীন প্রভাব খাটিয়ে নিরীহ ও সাধারণ মানুষের জমি-জমা জোরপূর্বক জবরদখল করে শত শত কোটি বানিয়েছেন। বিএনপি নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ গাজীর রোষানলে পড়ে নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। মিথ্যা মামলা দিয়ে অনেক মানুষকে জেল খাটিয়েছেন। গাজীর নির্দেশে চনপাড়ায় ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নব কিশলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রোমান মিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। অবিলম্বে গোলাম দস্তগীর গাজীর ফাঁসির দাবি জানান বিক্ষুব্ধরা। সেই সঙ্গে গাজীর দোসরদেরও গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানান তারা। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার, সোনারগাঁ, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় গোলাম দস্তগীর গাজীর নামে পৃথক পাঁচটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
গোলাপ গ্রেপ্তার : আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং মাদারীপুর-৩ (কালকিনি-ডাসার-সদর একাংশ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। গতকাল ১২/১ পশ্চিম নাখালপাড়ার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল এসব তথ্য জানান ডিএমপির তেজগঁাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোবারক হোসেন। জানা গেছে, আদাবর থানায় দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আবদুস সোবহান গোলাপ ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আওয়ামী লীগ নেতা নিজ দলের তাহমিনা বেগমের কাছে হেরে যান, যিনি মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। গত পাঁচ বছরে গোলাপের বিরুদ্ধে বিপুল দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে তিনি প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদ পান। এর আগে, তিনি দলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক ছিলেন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলে তার সংস্পর্শে আসেন গোলাপ। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারীও ছিলেন। পুলিশ বলছে, গত ৫ আগস্ট আদাবরের রিং রোডে মিছিলে অংশ নেন গার্মেন্টকর্মী রুবেল। বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৭ আগস্ট রুবেল মারা যান। এ ঘটনায় রুবেলের বাবা রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে আদাবর থানায় মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ১৫৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় গোলাপকেও আসামি করা হয়। মামলায় উল্লেখ করা হয়, আসামিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ, প্ররোচনা, সাহায্য, সহযোগিতা ও প্রত্যক্ষ মদদে মিছিলে গুলি করে রুবেল হত্যা করা হয়। প্রসঙ্গত, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ওই দিনই তিনি দেশত্যাগ করেন। এর পর পর থেকে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি ও অন্যান্য নেতার মতো আবদুস সোবহান গোলাপও আত্মগোপনে ছিলেন।