ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ যুক্তরাজ্যে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সেখানে তিনি পাচারের অর্থে শুধু বাড়িই কিনেছেন ৩৬০টি! কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে ভিনদেশে হাসিনা শাসনামলের সাবেক এই মন্ত্রীর সাম্রাজ্য গড়ে তোলার গল্প। এ নিয়ে বুধবার রাত থেকে গতকাল সারা দিন দেশ-বিদেশে ব্যাপক তোলপাড় হয়েছে।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়, রাজনৈতিক অঙ্গন, সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বিমা, আদালত, চায়ের দোকান, টিভি টকশো সব খানেই এই একটি বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় ওঠে। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল থেকে মোবাইলেও ঘুরেছে সেই নিউজের ভিডিও এবং লিঙ্ক। এমনকি বাসে- রিকশায় বসেও কানে ইয়ারফোন গুঁজে সেই ভিভিও দেখতে দেখা গেছে সাধারণ মানুষকে। অনেকেই করেন তির্যক মন্তব্য। তাদের প্রশ্ন, একজন মন্ত্রীই যদি বিদেশে এতগুলো বাড়ি কিনে থাকেন তাহলে অন্য মন্ত্রীদের কী অবস্থা? দেশের ব্যাংকসহ সমগ্র আর্থিক খাত তাহলে এ কারণেই ধসে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে আবার সদ্য সাবেক হওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার কড়া সমালোচনাও করেছেন।
প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝেও এ নিয়ে আলোচনা করতে দেখা গেছে। অবশ্য ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলা থেকে বিরত ছিলেন। সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এই বিপুল পরিমাণ বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। যদিও বিগত সময়ে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের প্রায় সব মন্ত্রী-এমপিরাই দেশে-বিদেশে অর্থের পাহাড় গড়েছেন। বিদেশে দেদার অর্থ পাচারও করেছেন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ব্লুমবার্গের এক বিশেষ প্রতিবেদনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে প্রায় ২০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের ৩৫০টিরও বেশি সম্পত্তির রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্য গড়ে তোলাসহ সম্পদের বিশাল ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। যুক্তরাজ্যে কোম্পানি হাউসের করপোরেট অ্যাকাউন্ট, বন্ধকি চার্জ এবং এইচএম ল্যান্ড রেজিস্ট্রি লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে এ পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়, যা নিয়ে তখন থেকেই তোলপাড় শুরু হয়। এদিকে বুধবার আলজাজিরার প্রচারিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরী যুক্তরাজ্যে ২৫০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ৩৬০টি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন, যা বাংলাদেশি অর্থে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার সমান। যুক্তরাজ্য ছাড়াও নিজের রিয়েল এস্টেট ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, নিউইয়র্ক, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত। সব মিলিয়ে তিনি ৫০০-এরও বেশি বাড়ি কিনেছেন। এগুলোর মূল্য প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ডলার।
আলজাজিরা বলছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বেশ ভালো সখ্য ছিল সাইফুজ্জামানের। আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমার বাবা শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক ছিলেন। আমিও তার কাছের লোক। শেখ হাসিনা আমার বস, তিনি জানেন যুক্তরাজ্যে আমার ব্যবসা আছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরী ২০১৭ সালের দিকে সম্পত্তি কেনা বাড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে যখন তিনি মন্ত্রী হন, তখন তা আরও বেড়ে যায়।
গত বছর বিনিয়োগকারীর ছদ্মবেশে আলজাজিরার সাংবাদিকরা সাইফুজ্জামানের ১৪ মিলিয়ন ডলারের বাড়িতে যান। ওই সময় ‘ছদ্মবেশী’ সাংবাদিকদের সাইফুজ্জামান বড়াই করে জানান, তিনি কুমিরের চামড়ার হাতে তৈরি জুতার ওপর হাজার হাজার ডলার খরচ করেন এবং লন্ডনের সবচেয়ে দামি দোকান থেকে ইতালিয়ান স্যুট তৈরি করে পরেন। ওই সময় লন্ডনের নিজের বাড়িও ঘুরিয়ে দেখান তিনি। বাড়িটিতে রয়েছে সিনেমা হল, জিম, ব্যক্তিগত এলিভেটর এবং নতুন রোলস রয়েলস গাড়ি রাখার নিরাপদ আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং এরিয়া। গতকাল দেশজুড়ে ‘টক অব কান্ট্রি’ ছিল সাইফুজ্জামান চৌধুরীর এই বিত্তবৈভবের খবর।