তিন পার্বত্য জেলায় জাতিগত সংঘাত-সহিংসতা রোধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। গতকাল পার্বত্য দুই জেলায় সফরে গিয়ে পাহাড় অশান্তকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন সরকারের উপদেষ্টারা। শুক্রবার খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে জাতিগত সংঘাতে চারজন নিহত হওয়ার পর গতকাল পাহাড়ের পরিস্থিতি ছিল থমথমে। রাঙামাটিতে গতকালও ১৪৪ ধারা অব্যাহত ছিল। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, চাপা আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয়দের মাঝে। ঘর থেকে বেরোচ্ছেন না পাহাড়ি ও বাঙালিরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে পুরো রাঙামাটি শহর। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও মানুষের মধ্যে উৎকণ্ঠা কাটেনি। এদিকে খাগড়াছড়িতে নিহত জুনান চাকমা, রুবেল ত্রিপুরা ও ধনরঞ্জন চাকমার দাহক্রিয়া পারিবারিক, সামাজিক লোকজন ও ইউপিডিএফ নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় পৃথকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল দীঘিনালা উপজেলার উদাল বাগান উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) দীঘিনালা ইউনিটের আয়োজনে বৃহস্পতিবার লারমা স্কয়ারে ধনরঞ্জন চাকমা হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ ও শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বক্তব্য দেন ইউপিডিএফ দীঘিনালা ইউনিটের সমন্বয়ক মিল্টন চাকমা, কেন্দ্রীয় নেতা চন্দন চাকমা, এলাকাবাসীর পক্ষে কৃপাপ্রিয় চাকমা, দীঘিনালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান চন্দ্র রঞ্জন চাকমা, বাবুছড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গগন বিকাশ চাকমা প্রমুখ।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক অবরোধের প্রথম দিন খাগড়াছড়িতে অতিবাহিত হয়েছে। দিনভর দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। উপজেলাগুলোর সঙ্গে আন্তসড়ক যোগাযোগও বন্ধ থাকায় সাজেকে কোনো পর্যটক যেতে পারেননি। অনেকেই খাগড়াছড়িতে আটকা পড়ে আছেন। অবরোধ চলাকালে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার ছিল। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। উল্লেখ্য, গত বুধবার খাগড়াছড়ি সদরের নোয়াপাড়ায় মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মামুন নামে এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে দীঘিনালা সরকারি কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পাল্টাপাল্টি হামলায় অগ্নিকা ও সংঘর্ষ ঘটে। এতে তিনজন নিহত ও নয়জন আহত হন।
সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, গত শুক্রবার দুপুরে খাগড়াছড়ির সহিংসতার জেরে রাঙামাটি শহরে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকজন বিক্ষোভ মিছিল করতে এসে নাশকতায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয় পাহাড়ি ও বাঙালির মধ্যে। উভয় পক্ষে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ঘটে। এ সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবহন। নিহত হন একজন। তারই প্রতিবাদে রাঙামাটিতে পাল্টাপাল্টি অবরোধ ও ধর্মঘট পালন করছে ইউপিডিএফ ও পরিবহন মালিক সমিতি। সহিংসতার প্রতিবাদে রাঙামাটিতে সড়ক ও নৌপথে ৭২ ঘণ্টা অবরোধ পালন করছে ইউপিডিএফ।
অন্যদিকে শুক্রবার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মিছিল থেকে রাঙামাটির বিভিন্ন পরিবহন বাস, ট্রাক, সিএনজি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে রাঙামাটিতে ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট পালন করছেন পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। এদিকে ইউপিডিএফের অবরোধ ও পরিবহন মালিক সমিতির ধর্মঘটের কারণে খোলেনি কোনো দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। বসেনি বাজার। ঘর থেকে বের হননি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালিরা। একইভাবে রাঙামাটি নৌপথে চলাচল করেনি কোনো লঞ্চ ও বোট। রাঙামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি-বান্দরবানের সড়কে চলাচল করেনি যানবাহন। তবে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘রাঙামাটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে আছে।’
পাহাড় অশান্তকারীর হাত ভেঙে দেওয়া হবে : এদিকে পাহাড় অশান্তকারীর হাত ভেঙে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি করলে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না। বারবার হুঁশিয়ারি দেওয়ার পরও ভবিষ্যতে কেউ আইনশৃঙ্খলার অবনতি করতে চাইলে তাদের কঠোরভাবে দমন করা হবে।’ গতকাল দুপুরে রাঙামাটি রিজিয়নের প্রান্তিক হলে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনায় বিশেষ আইনশৃঙ্খলা সভায় স্থানীয় পাহাড়ি ও বাঙালি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে বিকাল ৩টায় গণমাধ্যমকর্মীদের এসব কথা বলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী লে. জেনারেল (অব.) আবদুল হাফিজ, পুলিশের আইজি মো. ময়নুল ইসলাম, এনএসআই মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ, বিজিবি ডিজি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম ২৪ পদাতিক ডিভিশন জিওসি মেজর জেনারেল মো. মাইনুর রহমান, ৩০৫ পদাতিক ব্রিগেডের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শওকত ওসমান ও চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার রাজা দেবাশীষ রায় উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘পার্বত্যাঞ্চলে ঘটে যাওয়া সহিংসতার ঘটনায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোনো অবস্থায় অবনতি হতে দেওয়া যাবে না।
যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি করবে তাদের কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনকে সহযোগিতা করার জন্য পার্বত্যাঞ্চলে সব জাতি-গোষ্ঠীকে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ‘রাঙামাটি একটি সম্প্রীতির শহর। এখানে সব সম্প্রদায়ের বসবাস। সম্প্রীতি বিনষ্ট করার জন্য একটি তৃতীয় শক্তি ষড়যন্ত্র করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘পাহাড়ে সম্প্রীতি ধরে রাখতে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। কোনো বাইরের ষড়যন্ত্র যাতে পাহাড়ে অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।’
এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদসহ স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও বাঙালির সঙ্গে মতবিনিময় করেন উপদেষ্টারা। পরে রাঙামাটি শহরের সহিংসতার চিত্র ঘুরে দেখেন তাঁরা। এ সময় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা উপস্থিত থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
বিকালে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত মতবিনিময় সভা করেন উপদেষ্টারা। এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘মসজিদ, মন্দিরে যারা হামলা করবে তাদের কালো হাত ভেঙে দেওয়া হবে।’ পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে খাগড়াছড়িতে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।’ এজন্য তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন। খাগড়াছড়িতে উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেন, ‘একটি তুচ্ছ ঘটনা কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে ঘটে গেল আরও দুঃখজনক দুর্ঘটনা। আমরা যাতে এখানে মিলেমিশে পরস্পরের সম্পর্ক আরও গাঢ় করে তুলতে পারি এজন্য সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সম্প্রীতির মেলবন্ধন বাড়াতে হবে। বিচারবহির্ভূত কোনো ঘটনাকেই আমরা সাপোর্ট করি না।’ জেলার সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো. শহীদুজ্জামান।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন খাগড়াছড়ি রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ মোহাম্মদ আমান হাসান, মং রাজা সাচিং প্রু চৌধুরী, পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল, শিক্ষাবিদ প্রফেসর বোধিসত্ত্ব দেওয়ান, শিক্ষাবিদ ড. সুধীন কুমার চাকমা, জেলা বিএনপি সভাপতি ও সাবেক এমপি আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া প্রমুখ।