রবিবার বেলা ১টা। চোখে পড়ল, সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দপ্তরের ওয়েটিং রুম ও বারান্দায় অপেক্ষমাণ দর্শনার্থীদের ভিড়। কথা বলে জানা গেল, অনেকেই এসেছেন বিভিন্ন তদবির নিয়ে। কেউ এসেছেন নিজের কাজ নিয়ে, কেউ এসেছেন অন্যের হয়ে কিছু বলতে। দুপুর ২টায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফ্লোরে সচিবের দপ্তরের সামনে দেখা গেল ১৫ জনের বেশি দর্শনার্থী অপেক্ষমাণ। এ ছাড়া সচিবের দপ্তরের আশপাশে বিভিন্ন রুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন আরও ২০ জনের মতো। যাদের বেশির ভাগই এসেছেন বিভিন্ন সমস্যা অবহিত করে একটা ভালো বদলি বা পোস্টিং করাতে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সচিবালয়ে আওয়ামী ঘরানার লোকজনের আনাগোনা কমলেও তদবির থেমে নেই। গত সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন উপদেষ্টার দপ্তরে এ ধরনের ভিড় দেখা গেছে। এ ছাড়া সচিবদের দপ্তরেও দর্শনার্থীর চাপ প্রচুর। সচিবালয়ে প্রবেশের পাস বন্ধ থাকলেও নানাভাবে ম্যানেজ করে তারা প্রবেশ করছেন সচিবালয়ে।
জানা যায়, ১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী সচিবালয়ে এসব তদবিরকারীর বিষয়ে বিধিনিষেধ থাকলেও রাজনৈতিক সরকারের আমলে তা উপেক্ষিত হতো। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও দৌরাত্ম্য কমেনি তদবিরকারীদের। যারা তদবির করছেন তাদের অনেকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, ডাক্তার প্রভৃতি। নিজেদের পদোন্নতি ও পোস্টিং নিয়ে নানামুখী তদবির করতে আসেন প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে। অনেক সময় বিভিন্ন পরিচয়ের সমন্বয়কদেরও দেখা যাচ্ছে সচিবালয়ে। শুধু রাজধানী নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে উপদেষ্টা ও সচিবদের দপ্তরে প্রতিদিন নানামুখী আবদার নিয়ে হাজির হচ্ছেন অনেকে। তাদের তদবিরে তটস্থ উপদেষ্টারা। ইতোমধ্যেই এসব তদবির নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ প্রমুখ। তবে তদবির যেন থামছেই না! দেশের বিশিষ্টজনরা মনে করছেন তদবিরবাজদের বিষয়ে সরকার কঠোর না হলে এর লাগাম আরও বেড়ে যাবে। তারা তদবির বিষয়ে বিধিমালা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমাদের কাছে প্রতিদিন নানা ধরনের তদবির আসছে- এটা ঠিক। এতে খুবই অসুবিধাও হচ্ছে। কাজের ক্ষতি হচ্ছে। তবে সিদ্ধান্তটা কিন্তু আমরাই নিচ্ছি। তদবির করলেই-সেটি গুরুত্ব পাবে বিষয়টি তেমন নয়। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন নানা দাবি-দাওয়ার আন্দোলন চলছিল- সেটা কিন্তু কমে এসেছে। আমরাও এ নিয়ে কাজ করছি। সমন্বয়কদের কিছু বিষয় আছে- আমরা ফাউন্ডেশন করেছি। তবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তদবির বেশি সেটিও উল্লেখ করেন এ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, তদবির কমবেশি আসতেই থাকবে। তবে সবার কথা শুনতে গেলে কাজে ক্ষতি হয়, বিড়ম্বনা হয়।
গত ৫ আগস্টের পর একেবারেই বন্ধ রয়েছে সচিবালয়ে প্রবেশে পাস ইস্যু করা। কর্মকর্তারা কারও নামে পাস ইস্যু করতে পারছেন না। অফিসের কোনো মিটিং থাকলে নামের তালিকা প্রবেশ পথে (গেটে) পাঠানো হয়। এর বাইরে যারা আসছেন- তারা বিভিন্ন মাধ্যমে কখনো পুলিশের সহায়তায়, কখনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ফোনে বলে দিচ্ছেন দর্শনার্থীকে সচিবালয়ে প্রবেশ করানোর জন্য। পাস বন্ধ থাকলেও এভাবে প্রতিনিয়িত শত শত মানুষ প্রবেশ করছেন সচিবালয়ে-যাদের বেশির ভাগের কাজই তদবির করা। সচিবালয়ে এখন বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পদোন্নতি ও পোস্টিং নিয়ে তদবির লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরেও অনেকেই আসছেন পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলি হতে, কেউ পছন্দের হাসপাতালের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিচ্ছেন। অনেকেই জেলা থেকে ঢাকা বা আশপাশে বদলি হয়ে আসতেও তদবির করছেন। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে বদলি হতে ঘুরছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামের সমন্বয়কদেরও দেখা যাচ্ছে সচিবালয়ে। রবিবার দুপুরে দুই ব্যক্তি নিজেদের সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় আশপাশের অনেকে বলতে থাকেন, কে আসল সমন্বয়ক আর কে নামধারী সেটা বুঝা মুশকিল, আদৌ প্রকৃত সমন্বয়ক কিনা সেটাই বলবে কে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এখন প্রায় প্রতিদিন হাজার খানেক দর্শনার্থী আসছেন। কেউ মাউশি, কেউ এনসিটিবি, কেউ ব্যানবেইসসহ নানা জায়গায় বদলি-পোস্টিং চাচ্ছেন। তিনি জানান, সচিব স্যারকে প্রতিদিন শতাধিকের মতো দর্শনার্থীর সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে। আর বাকিদের সামলাচ্ছেন স্যারের পিএস। সচিবালয়ে তদবির বেশি আর সবচেয়ে বেশি এই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বলেন ওই কর্মকর্তা। এদিকে রবিবার বিসিএস শিক্ষা ৪১ ব্যাচের কিছু কর্মকর্তা এক সচিবের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের কাজে যোগদান নিয়ে কথা বলতে আসেন। অসুস্থতার কারণে তারা যথাসময়ে যোগ দিতে পারেননি, সেটি বলতেই সচিবের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিদিন সিনিয়র সচিবের দপ্তরে ভিড় লেগে থাকছে। যাদের অনেকেই আবার অবসরে গেছেন। তারা আসছেন তাদের পুরনো বিষয় নিয়ে। এক অতিরিক্ত সচিব বলেন, অনেকেই নিজেদের বঞ্চিত উল্লেখ করে ভালো পোস্টিং চাচ্ছেন। অনেকেই দল বদল করে রং পাল্টিয়ে, ভোল পাল্টিয়ে তদবির করে নিজের জন্য কিছু আদায় করার চেষ্টায় আছেন। জনপ্রশাসনে অনেক কর্মকর্তা ছুটছেন পছন্দের জেলার ডিসি হতে। জনপ্রশাসনে সচিবের দপ্তরের চেয়েও বেশি ভিড় লেগে থাকছে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগে। যাদের পদোন্নতি এখনো আটকে আছে তারাসহ অনেকেই আসেন নিজেদের ভালো পোস্টিংয়ের জন্য। আবার অনেকেই ব্যাচম্যাট বা নিজের সহকর্মীর বদনামও করতে আসেন সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে। জনপ্রশাসনের এক যুগ্ম সচিব বলেন, আমরা নিজেরাই নিজেদের জন্য দায়ী। ভালো কাজের মূল্যায়ন হলে তদবির লাগে না। কিন্তু সবখানে প্রতিযোগিতা এখন এমন যে কার আগে পোস্টিং পাবে, কে কত ভালো জায়গায় পাবে। শুধু তাই নয়, আরেক সহকর্মী যাতে ভালো পোস্টিং না পায় এজন্য স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রীতিমতো নানা মিথ্যাচারও করছেন কেউ কেউ।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও একই দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিদিন বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা আসছেন নানা তদবির নিয়ে। কেউ আসছেন ভালো পোস্টিং পেতে। কেউ আসছেন ভালো হাসপাতালে বদলির জন্য। উপদেষ্টার সাক্ষাৎ না পেলে ছুটছেন স্বাস্ব্য সচিবের কাছে। নিজের স্বার্থ হাসিলে অনেকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকছেন মন্ত্রণালয়ে। সারা দেশের বিভিন্ন সিটি করপোরেশন, পৌরসভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় স্থানীয় সরকার বিভাগে জনপ্রতিনিধিদের তদবির কম। তবে কর্মকর্তাদের তদবির রয়েছে। একই অবস্থা ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়েও। বিভিন্ন বন্যা বা দুর্যোগ হলে বরাদ্দ পেতে যে ভিড় লাগে- সে তুলনায় কম। তবে অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিদিনই কম-বেশি নানা তদবির নিয়ে আসছেন অনেকেই।
তদবিরের বিষয় নিয়ে সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ন্যায্য কাজগুলো আগে আগে অর্থাৎ বিদ্যুতের গতিতে করে ফেলা দরকার। তাহলে ভিড় কমবে, পাশাপাশি অন্যায় কাজের জন্য মানুষ আসবে না। তারাও মনে করবে ন্যায্য কাজ আটকে নেই। যারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তদবির করে, এটা কাক্সিক্ষত নয়। তবে এটা আমাদের রক্তে মিশে গেছে। এই তদবির নিরুৎসাহিত করতে যারা নীতিনির্ধারক বা কর্তৃপক্ষ আছেন, তাদের একটা উপায় বের করতে হবে। এর মধ্যে একটা কিন্তু ওই ন্যায্য কাজ দ্রুত করা, সেটি হতে পারে। অন্যায় কাজ যে আপনি করেন না, সে বিষয়ে বার্তা দেওয়া, ভাবমূর্তি তৈরি করাও একটি উপায়। তদবির নিয়ে সবসময় নিরুৎসাহিত করার কথাই বলব। সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোস্টিংয়ের জন্য দৌড়ঝাঁপ ও তদবির থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এদিকে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ ‘২৪তম আইসিএবি ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানে জানান, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে প্রায় এক মাসে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ১ হাজার ৭০০টি হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা পেয়েছেন। বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ ও তদবিরের জন্যই মূলত এসব বার্তা পাঠানো হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে নানা ধরনের অনুরোধ আসে উল্লেখ করে উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কেউ বলে, স্যার, এই লোক চুরি করে, একে দায়িত্ব থেকে সরান। কিংবা ওই লোক ভালো, তাকে দায়িত্বে আনেন। এভাবে নানা বার্তা আসে। এর মধ্যে অনেক প্রকৃত অভিযোগ রয়েছে। আবার অনেকে নিজের স্বার্থের জন্যও বলে। তবে যারা প্রকৃত অভিযোগ তুলে ধরে, সেগুলো বিবেচনা করা হচ্ছে।’ এ ছাড়া তদবির নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। গত ১৫ সেপ্টেম্বর উপদেষ্টার ভেরিফাইড ফেসবুক আইডিতে এক পোস্টে আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই বলেছিলাম, ব্যক্তিগত তদবির-আবদার নিয়ে কেউ আসবেন না। এখনো প্রতিদিন যদি ৫০ জন দেখা করতে আসেন, তার মধ্যে ৪৮ জনই আসেন নানারকম তদবির নিয়ে।’