সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে গতকাল আন্দোলনকারী চাকরিপ্রত্যাশীরা রাজধানীর শাহবাগে অবস্থানের পর প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। পরে সেখান থেকে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে। সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়ানো হবে কি না, তা পর্যালোচনা করতে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করে সরকার। বিকালে আন্দোলনরতদের একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবন যমুনায় প্রবেশ করেন। রাত ৯টায় রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বৈঠক চলছিল। এর আগে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা জানান, তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চান। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া কারও সঙ্গে তাঁরা আলোচনা করতে চান না। সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। গতকাল বিকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এ কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে কমিটির আহ্বায়ক এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানকে সদস্যসচিব করা হয়েছে।
এর আগে দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে কয়েক শ যুবক রমনায় প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। এক পর্যায়ে তাঁরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। কিন্তু তাঁরা পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে এগোতে থাকলে ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে শুরু করে। এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আন্দোলনকারীরা দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপের আগে লাঠিচার্জ করা হয়। এতে কয়েকজন আন্দোলনকারী আহত হন। এর পরও তাঁরা সড়ক ছেড়ে যাননি। পরে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের চারদিকে পর্যাপ্ত পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিতে থাকেন। এর আগে বেলা ১১টায় শাহবাগে অবস্থান করে আন্দোলন শুরু করেন চাকরিপ্রত্যাশীরা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম ও অপারেশনস্) ইসরাইল হাওলাদার বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে সভাসমাবেশ করার বিষয়ে আগেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশের নিষেধ অমান্য করে প্রধান উপদেষ্টার বাসার সামনে যান।
প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে কয়েক শ চাকরিপ্রত্যাশীর অবস্থানের ফলে বেইলি রোড, কাকরাইল ও মৎস্য ভবন এলাকা থেকে উত্তরা অভিমুখী সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, সকাল থেকে শাহবাগ এলাকায় শত শত চাকরিপ্রার্থী উপস্থিত হয়ে নানা ধরনের স্লোগান দেন। আন্তর্জাতিক মানদ অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি ছাড়াও শর্ত সাপেক্ষে বয়সসীমা উন্মুক্ত করারও দাবি করেন তাঁরা। চাকরিপ্রত্যাশীদের এ আন্দোলনে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও পড়াশোনা সম্পন্ন করা বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ। এমনকি তাঁদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চনও।
এদিকে বিকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বাসভবনে কর্মকর্তাদের সঙ্গে চাকরিতে আবেদনের বয়স ৩৫ করা নিয়ে কয়েকজন আন্দোলনকারী দেখা করেন। কিন্তু আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
বিকাল সাড়ে ৩টায় যমুনা থেকে বেরিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হন ৩৫ চাকরিপ্রত্যাশী রাসেল আল মাহমুদ। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ভিতরে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। পরে তিনি মাইকে ঘোষণা দেন-আমাদের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনার পর বলা হয়েছে, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর সঙ্গে সেখানকার লোকজন কথা বলছেন। কিন্তু আমরা যখন বললাম, তাঁর সঙ্গে আমরা কথা বলব, তখন তাঁরা সময় ক্ষেপণ করছেন। তাঁরা বলছেন এখন তাঁকে পাওয়া যাবে কি না, তিনি দপ্তরে আছেন কি না, ইত্যাদি। মাহমুদের মাইকে ঘোষণার সময় আন্দোলনকারীরা ‘বয়স না মেধা, মেধা মেধা; ৩০ না ৩৫, ৩৫, ৩৫; আর নয় কালক্ষেপণ, আজই প্রজ্ঞাপন’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়ে সরকারকে সুপারিশ দিতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে এ কমিটি করা হয়। এটিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দাবি ও চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়সহ সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এরপর বিকাল পৌনে ৫টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য এক ঘণ্টার আলটিমেটাম দেন আন্দোলনকারীরা।
আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক আবু সাঈদ সাদ জানান, তাঁরা এক যুগ ধরে আন্দোলন করে আসছেন। সরকারি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে তাঁরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। বিগত সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনেও তাঁরা সক্রিয় ছিলেন। অথচ এখনো তাঁদের যৌক্তিক দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে না।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার বিষয়ে কমিটি গঠন : সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর দাবির বিষয়ে সুপারিশ দিতে কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটির প্রধান করা হয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীকে। এ কমিটি আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন জমা দেবে। পরে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়। গতকাল সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, গঠিত কমিটি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দাবি এবং চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে। কমিটির আহ্বায়ককে ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে যে কজন সদস্য প্রয়োজন তিনি নেবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, সরকারি চাকরিতে বয়স বাড়ানোর বিষয়ে যারা আন্দোলন করছেন তাদের কোনো আশ্বাস দিচ্ছি না, তবে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।