দেশের ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী বছর ডিসেম্বরের মধ্যে হতে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ভিতরে ভিতরে নিবাচন অনুষ্ঠানের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করছে। নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি গঠন করতে ইতোমধ্যে পুনর্গঠন করা হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশন। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যার যার অবস্থান থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব তৈরি করছে। সরকার ইতোমধ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও সংস্কার কমিটির সুপারিশ জমা হলে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানা গেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আজ দুই মাস ১১ দিন। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে সরকারের আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয়, আগামী বছরের মধ্যে নির্বাচন করাটা হয়তো সম্ভব হতে পারে। অনেক ফ্যাক্টর রয়েছে। এটা প্রাইমারি অ্যাজাম্পশন (প্রাথমিক অনুমান)।’ আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের জন্য অনেক ধাপ রয়েছে। নতুন নির্বাচন কমিশনের জন্য সার্চ কমিটি লাগবে। সার্চ কমিটি করতে হলে পিএসসির চেয়ারম্যান লাগবে। সেটার নিয়োগ হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। সঠিক ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচনের জন্য এসব ধাপ চিন্তা করতে হবে। কিছুদিনের মধ্যে সার্চ কমিটি হবে। এরপর নির্বাচন কমিশন গঠন হবে।’ তিনি বলেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই ভুয়া নির্বাচন কমিশন থেকে নির্বাচন করা হোক, সেটা চান না। নিশ্চয়ই কেউ চায়নি হাবিবুল আউয়াল কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেবে। এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে না।’ আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রথম কাজ হবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা। ফ্যাসিস্ট সরকার ২০২৪ সালের ভুয়া নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়ে ব্যাপক অরাজকতা করেছিল। হয়তো ভয় ছিল, নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে কী অবস্থা হবে।’ আইন উপদেষ্টা মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনারা অনুসন্ধান করুন, ২০২৪ সালের ভোটার তালিকার নামে কী করা হয়েছিল। সুতরাং ভোটের আগে একটি সুষ্ঠু ভোটার তালিকা করতে হবে। নির্বাচন কমিশন ছাড়া এ ভোটার তালিকা তৈরির আদেশ কেউ দিতে পারে না। প্রধান উপদেষ্টার আদেশে ভোটার তালিকা হবে না। নির্বাচন কমিশনের আদেশে হবে।’
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট দায়িত্বভার গ্রহণ করে রাষ্ট্র সংস্কারে মনোযোগ দেয় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। তার অংশ হিসেবে আগামী বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচন টার্গেট করে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নির্বাচন কমিশন সংস্কারে কমিশন গঠন করে দেওয়া হয়। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দিতে এ কমিশন কাজ শুরু করেছে। সংস্কার এবং নির্বাচন সামনে রেখে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, এ বি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সংস্কার এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে।
গত ১২ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি।’ একই দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করে জামায়াতে ইসলামী। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমাদের দেওয়া দুটি রোডম্যাপের মধ্যে একটি সংস্কারের এবং আরেকটি নির্বাচনের। আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে দেশকে ভালো জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে। এ ক্ষেত্রে এটাও আমরা আশা করছি, এ সময়টা নাতিদীর্ঘ হবে।’
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশই দলই ৩০০ আসন টার্গেট করে সারা দেশে দল চাঙা করছে। দেশের সাধারণ মানুষও মেতে উঠতে চায় নির্বাচনি উৎসবে। তবে তারা এও বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি ভোট আয়োজন করে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এ কাজে সহযোগী হিসেবে পাশে ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে সরকার পতনের পর নির্বাচনব্যবস্থা নতুন করে সাজাতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে। নির্বাচন প্রসঙ্গে ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দ্রুত সংস্কারকাজ এগিয়ে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কথা জানান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারকাজ করা এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার। তাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা। তারও আগে ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জানান, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যেন নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবেন। এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ হওয়া উচিত। জানা যায়, ২০২৫ সালের নির্বাচন সামনে রেখে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারকে প্রধান করে গঠিত নির্বাচন কমিশন (ইসি) সংস্কার কমিশন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে। আগামী তিন মাসের মধ্যেই এ কমিশন সুপারিশ চূড়ান্ত করে সরকারের কাছে জমা দিতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন কমিশনপ্রধান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচনি আইনগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এরপর সেগুলোর ত্রুটিবিচ্যুতি তুলে ধরা হবে।’ জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ডামাডোল শুরু না হলেও আওয়ামী লীগ বাদে অন্য দলগুলো প্রতিটি আসনে প্রার্থী দিতে কাজ শুরু করেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব দলই এককভাবে সারা দেশে ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সাবেক এমপি অধ্যাপক মুজিবুর রহমান নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে জেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামে জেলা জামায়াতের রুকন সম্মেলনে বলেছেন, ‘জামায়াত আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে।’ বিএনপি, জামায়াত, এ বি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদই নয়, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, এলডিপি, জাতীয় পার্টি-জেপি, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, ন্যাশনাল পিপলস পাটি-এনপিপি, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, তৃণমূল বিএনপি, গণসংহতি আন্দোলন নির্বাচন সামনে রেখে দল গোছাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রচার ও দাওয়াহ সম্পাদক মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে এককভাবে ভোট করার লক্ষ্যে দল তৃণমূল থেকে সংগঠিত করা হচ্ছে।’