রবিবার, ১০ জানুয়ারি, ২০১৬ ০০:০০ টা

এক চিকিৎসকের বিরল দৃষ্টান্ত

সৈয়দ নোমান, ময়মনসিংহ

এক চিকিৎসকের বিরল দৃষ্টান্ত

তিনি পরিচ্ছন্নতা কর্মী নন, চিকিৎসক। দিনমান মানব সেবায় ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু  তারপরও ক্ষান্ত হন না। চিকিত্সা সেবার পর তিনি নামেন এলাকার ড্রেন পরিষ্কারের কাজে। আর এভাবে এ কাজটা তিনি করে আসছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে একেবারেই নীরবে-নিভৃতে। যদিও শেষ পর্যন্ত চাপা থাকেনি নিভৃতচারিতা। ফেসবুক ফাঁস করে দিয়েছে তার এই কীর্তির কথা। গত বুধবার কয়েকটি ছবি হঠাৎ করেই ছড়িয়ে পড়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। হৈচৈ পড়ে যায় সর্বত্র। সমাজসেবায় নিভৃতে এমন কাজ করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন ডা. কাজল কান্তি চৌধুরী। কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তিনি। জানা গেছে, নিজের বাড়িসহ আশপাশের ড্রেনে পানি প্রবাহ সচল রাখতে ২০০০ সাল থেকে এ কাজ করে আসছেন ডা. কাজল। ড্রেনে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন জমে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিজের কাজ নিজে করার প্রবণতা থেকে তিনি ড্রেন পরিষ্কারের কাজে মনোনিবেশ করেন। আরও জানা গেছে, ছোটবেলা থেকেই তিনি এমন স্বভাবের। নিজের নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি গ্রামের বাড়ি এলাকায় একটি বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে— এমন খবরে সব এলাকাবাসীর সঙ্গে মাটি ফেলার কাজে যোগ দিয়েছিলেন তিনিও। তখন তার বয়স ছিল প্রায় ১২ বছর। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডা. কাজল প্রথমদিকে রাতের আঁধারে একাকী করতেন এ কাজ। কিন্তু সম্প্রতি এ কৌশল পাল্টে ফেলেন। গত বুধবার তিনি দিনদুপুরে সড়কের ড্রেন পরিষ্কার করছিলেন। এমন সময় স্থানীয় এক তরুণ এ দৃশ্য ক্যামেরায় ধরে ফেলেন। তারপর তার কলেজের এক শিক্ষার্থী সেই ছবি সংগ্রহ করে ফেসবুকে পোস্ট করেন। ব্যস, তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যায়। প্রবীণ এ চিকিৎসকের এমন দৃষ্টান্তে তাকে সাদা মনের মানুষ হিসেবে আখ্যা দেন অনেকেই। গত বৃহস্পতিবার রাতে শহরের মাসকান্দা এলাকায় ওই চিকিৎসকের বাড়িতে গেলে প্রথমে তিনি কথা বলতে রাজি হননি। পরে অনুরোধের কারণে অল্প কথা বলেন। বলেন, তার এ কাজ শখ করে করা নয়, দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এটা করেন। তিনি আরও বলেন, ‘নিজের বাসার সামনের ড্রেনে ময়লা-আবর্জনা জমে থাকার কারণে পানির প্রবাহ আটকে যায়। এতে শুধু আমাদের নয়, অনেকেরই সমস্যা হয়। এটা দেখলে খুবই খারাপ লাগে। এ কারণেই ১৫ বছর ধরে নিজের হাতে এ কাজ করছি। কিন্তু আমি প্রচারণা চাই না।’ তার বাসার ঠিক উল্টো দিকেই সুমাইয়া লন্ড্রির স্বত্বাধিকারী মো. শাহ আলম ডা. কাজল সম্পর্কে বলেন, ‘ড্রেন পরিষ্কার করার লাইজ্ঞা একটা লাডি বানাইয়া লইছে। এই কাম স্যারের নেশা। প্রতিদিনই করে। হয় দিনে নয় রাইতে।’ বাড়ির পাশের লিবার্টি হাসপাতালের পঞ্চাশোর্ধ দারোয়ান মো. মোর্শেদ আলী বলেন, ‘হে তো অনেক বড় ডাক্তর। এরুম ডাক্তর আর হইব না মনে হয়। বুধবার ১১টাত্তে কাম শুরু কইরা দুফুর ৩টা লাগাদ করছে। নিজে যে এত্ত বড় মাপের মানুষ এইডা মনেই করে না।’ এ ছাড়াও স্থানীয় অন্যান্যরা জানান, নিজের বাড়ির সামনে থেকে বিসিকের মোড় পর্যন্ত নিয়মিতই ড্রেন পরিষ্কার করেন এ চিকিৎসক। নিজের হাতে ড্রেন পরিষ্কারের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ রয়েছে বলেও জানান ডা. কাজল কান্তি চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে নিজেদের অবস্থান থেকে সবারই কাজ করা উচিত।’ জানা যায়, ডা. কাজল কান্তি চৌধুরীর বাবা জুগেন্দ্র চন্দ্র চৌধুরীও ছিলেন একজন চিকিৎসক। চিকিৎসক বাবার সন্তান চিকিৎসক কাজল নিজেও বিয়ে করেন আরেক চিকিৎসক দাস রিক্তাকে। তাদের দুই ছেলেও চিকিৎসক। এদিকে ফেসবুকে ডা. কাজল কান্তি চৌধুরীর ব্যক্তি উদ্যোগে একাকী পরিচ্ছন্নতা অভিযানের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছবিসহ একটি পোস্ট দিয়েছেন কমিউনিটি বেজড মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী। তার নাম সোহান তৌহিদ। তিনি লিখেছেন এমন, ‘স্যার কখনো রাগেন না। বায়ু দূষণ একজন কমাবে, এই ভেবে তিনি গাড়ি কেনেননি। দেশকে উনার মতো মানুষরা শুধু দিয়েই যাবেন। রেসপেক্ট।’ অন্য এক শিক্ষার্থীর আরেকটি স্ট্যাটাসে রঞ্জনা ব্যানার্জী নামের একজন লিখেছেন, ‘শ্রদ্ধা। এমন শিক্ষকের ছাত্ররা শিক্ষকের সম্মান রাখুক, সামাজিক দায়বদ্ধতায় সেটাই হবে তাকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য।’ মিহির কান্তি নামের আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘স্যারকে শ্রদ্ধা জানাই। এরকম দৃষ্টান্ত বিরল।’

সর্বশেষ খবর