সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা
জেলা প্রশাসনের সংগ্রহশালায় ঐতিহাসিক নিদর্শন

রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ২৮৫ প্রেমপত্র

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর

রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার ২৮৫ প্রেমপত্র

আনুমানিক ১৫০ বছর আগে দিঘাপতিয়ার রাজকন্যা ইন্দুপ্রভার লেখা এবং গোপনে তুলে রাখা ২৮৫টি প্রেমপত্র এখন নাটোর জেলা প্রশাসনের সংগ্রহশালায়। ট্রেজারিতে সংরক্ষিত চাবিবিহীন একটি ট্রাঙ্ক থেকে সম্প্রতি এই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ট্রাঙ্ক থেকে আরও মিলেছে তাঁর অপ্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি, দিনলিপি, রুপার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, রাজকীয় দোয়াত-কলমসহ বেশকিছু দ্রব্য।

এর আগে গ্রামের মানুষের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে রাজবাড়ির সিন্দুক, রাজা-রানীর ছবি, মূল্যবান পাথরখচিত রাজমুকুট, রাজপরিধেয়সহ বেশকিছু জিনিসপত্র। গতকাল এগুলো উত্তরা গণভবন সংগ্রহশালায় দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। মূলত ১৯৫৬ সালে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর এই রাজপরিবার ভারতে চলে যায়। এর পর থেকে হারাতে থাকে মূল্যবান জিনিসগুলো। সম্প্রতি নাটোরের জেলা প্রশাসন খোঁজা শুরু করে দিঘাপতিয়ার রাজার হারিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র। গণভবনসংলগ্ন এলাকাগুলোয় খোঁজ করে উদ্ধার করা হয় সিন্দুক, রাজা-রানীর ছবি। এর মধ্যে জেলা প্রশাসনের ট্রেজারিতে একটি ট্রাঙ্কের ওপরে লেখা রয়েছে ‘রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা’। ট্রেজারিতেই পাওয়া যায় মহামূল্যবান পাথরখচিত রাজার মুকুট, জরির জামা, হাতির দাঁতের হাতল লাগানো ছুরি, দামি পাথর কেটে তৈরি রাজবাড়ির থালাবাসন। এরই মধ্যে একটি ছবিও পাওয়া যায়। এটি রুপার ফ্রেমে বাঁধানো। ছবিটির পরিচয় খুঁজতে গিয়ে ফ্রেম খোলা হয়। দেখা যায়, ফ্রেমে আড়াল হয়ে ছিল রাজকুমারী ইন্দুপ্রভার নাম। রাজবংশের চতুর্থ পুরুষ প্রমথনাথের কন্যা ছিলেন ইন্দুপ্রভা। গত সোমবার ট্রাঙ্ক থেকে বের করা হয় ইন্দুর হাতের লেখা ১০টি ডায়েরি। এর মধ্যে একটিতে শুধু কবিতা। অন্যগুলোয় তাঁর আত্মজীবনী। ইন্দুর কাছে বিয়ের আগে ও পরে ২৮৫টি চিঠি লিখেছেন মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। প্রতিটি চিঠির শেষে লেখা রয়েছে ‘তোমারই মহেন্দ্র’। চিঠির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে মান-অভিমান। ইন্দুপ্রভা কলকাতায় থাকার সময় তাঁকে তিনটি ঠিকানায় চিঠি লেখা হয়েছে। আবার ইন্দু যখন রাজবাড়িতে থেকেছেন, তখনো কলকাতা থেকে মহেন্দ্র তাঁকে চিঠি লিখেছেন। দিঘাপতিয়া চিঠিপত্রে তাঁর নাম কখনো ‘রাজকুমারী ইন্দুপ্রভা’, কখনো ‘শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা দেবী’, আবার কখনো ‘শ্রীমতী ইন্দুপ্রভা চৌধুরানী’ লেখা পাওয়া গেছে। মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ইন্দুপ্রভার স্বামী। তবে তাঁর বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি। ছোট্ট ছোট্ট খামে ভরা চিঠিগুলো খুবই যত্নে ভাঁজ করে রাখা। প্রায় ১২০ বছর বা তার কাছাকাছি সময় ধরে চিঠিগুলো ওভাবেই খামের ভিতরে রয়েছে। চিঠিগুলো এখনো পড়া যাচ্ছে। একইভাবে ইন্দুর হাতের লেখা কবিতা ও তাঁর আত্মজীবনীও পড়া যাচ্ছে। ‘বঙ্গোপসাগর’ কবিতায় ইন্দুপ্রভা লিখেছেন : ‘সচঞ্চল নীল জল করিছে কি ঝলমল/জ্যোত্স্না মাখিয়া গায় সমুজ্জ্বল নিরমল’। ডায়েরির অনেক লেখাই তিনি রাজশাহীতে বসে লিখেছেন। ১৩১১ বঙ্গাব্দের নববর্ষের দিনের কথা লিখেছেন রাজশাহীতে বসে। রাজশাহীকে তখন রামপুর লেখা হতো। প্রতিটি লেখার সঙ্গে তিনি বাংলা ও ইংরেজি তারিখ, বারসহ লিখেছেন। ১৩০৪ সালে দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির প্রাইভেট সেক্রেটারির প্যাডে মহেন্দ্র কলকাতার ঠিকানায় ইন্দুকে লিখেছেন। বার বার তাগাদা দিয়ে খাম পাঠিয়েও ইন্দুর চিঠি পেতে দেরি হওয়ায় মহেন্দ্র তাঁর চিঠির শেষ বাক্যে লিখেছেন : ‘একবার কলকাতায় যেতে পারলে বাঁচি।’ তখন যে দোয়াত-কলম ব্যবহৃত হতো সেগুলোও অবিকল রয়েছে ইন্দুর ট্রাঙ্কে। এমন দুর্লভ স্মৃতিচিহ্নের সন্ধানে দারুণ খুশি নাটোরের মানুষ। তারা দেরিতে হলেও রাজা-রাজন্যের স্মৃতিধন্য নাটোরের রাজা-মহারাজা ও রানী ভবানীর নানা ঐতিহাসিক সামগ্রী সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ায় জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর