জেলেরা ধরার পর অন্তত তিন-চার হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায় মাছের রাজা ইলিশ। প্রতিটি হাত অন্তত ১০০ টাকা লাভ রাখায় মূল দামের চেয়ে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দামে মাছটি সাধারণ ক্রেতাকে কিনতে হয়। জেলেদের হাত ঘুরে একটি ইলিশ যখন ঢাকার বাজার থেকে ক্রেতা কিনছেন তখন তাতে বিক্রেতারা ৭০০ টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন। অনলাইনে তারা হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন। গত এক সপ্তাহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলার মাছের আড়ত, জেলে, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য উঠে আসে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে মাছের দাম বৃদ্ধির পেছনের বেশ কয়েকটি কারণ। দাম বৃদ্ধির পেছনে সক্রিয় আছে সিন্ডিকেট। বাজার মনিটরিং না থাকায় মাছ বিক্রেতারাও ইচ্ছেমতো ইলিশের দাম বাড়াচ্ছেন। আবার সাগর এবং নদীতে ইলিশ আহরণকারী একাধিক জেলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবার ইলিশের মৌসুমে সাগর বা নদীতে মাছটির উপস্থিতি অনেক কম। ফলে মাছ কম ধরা পড়ায় ঢাকার বাইরে থেকেই ব্যবসায়ীদের বাড়তি দামে ইলিশ কিনতে হচ্ছে আর ঢাকার বাজারে এসে এর দাম আরও বেড়ে যাচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে জেলেরা জালের দাম, নৌকার জ্বালানিসহ অন্য খরচ দিয়ে কাঙ্ক্ষিত মাছ না পেয়ে বাড়তি দামে মাছটি বিক্রি করছেন।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই বিশ্বের বেশির ভাগ ইলিশ আহরণকারী দেশ বাংলাদেশ। একসময় সুস্বাদু এ মাছটি দেশের মানুষের নাগালের মধ্যে থাকলেও কয়েক বছর ধরে অতিরিক্ত দামের কারণে ইলিশ এখন সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সাধারণত ইলিশের ভরা মৌসুম জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর। এবার ভরা মৌসুমেও সাধারণ মানুষ দামের উত্তাপে মাছটি পাতে তুলতে পারছে না। বিভিন্ন জেলা প্রতিনিধর পাঠানো তথ্যে দেখা যায়, জেলের জালে ধরা পড়া ইলিশ তিন থেকে চার হাত ঘুরে ক্রেতার কাছে আসে। এসব জায়গায় দামের পার্থক্যের কারণে বাজারেও এর দাম ওঠানামা করে। এ ছাড়া সমুদ্র-মোহনা থেকে ধরা মাছ আর নদীর উজানের মাছের ক্ষেত্রেও দামে কিছুটা পার্থক্য আছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আসা ইলিশ সাধারণত চারটি ভাগে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ১ কেজি বা এর বেশি সাইজের ইলিশের পাইকারি দাম ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা; যা একই বাজারে পরে ১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এরপর ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশের পাইকারি দর ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা; যা পরে খুচরা বাজারে ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। তৃতীয় ক্যাটাগরিতে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের পাইকারি দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং খুচরায় ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি। জাটকা বা ছোট সাইজের ইলিশ পাইকারি ৫০০ এবং খুচরা ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যে দুই বছরের ব্যবধানে প্রতি কেজি ইলিশের দামে বেড়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোর পাশাপাশি সুপার শপ এবং ফেসবুকের বেশ কয়েকটি পেজেও ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে বাজারের তুলনায় অনলাইনে ইলিশের দাম আরও বেশি। সুপার শপ ‘স্বপ্ন’য় ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের প্রতি পিসের দাম ৭৯৫ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের দাম ১৩৫০ টাকা এবং ১ কেজি থেকে ১২০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজির দাম ২০৯০ টাকা।
অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এবার প্রথমে ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে না বলে জানালেও পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ২ হাজার ৪২০ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয়। মাছ বিক্রেতার অনেকেই ইলিশের দাম বাড়ার জন্য ভারতে রপ্তানির যুক্তি তুলে ধরেন।
সক্রিয় সিন্ডিকেট : ইলিশ মাছের বাজারের উচ্চমূল্যের জন্য কেউ কেউ সিন্ডিকেটকে দায়ী করছেন। আড়তে আসা ইলিশ যাচ্ছে ফ্রিজিং করে মজুতদারদের ঠান্ডা গুদামে। এর সঙ্গে সক্রিয় আছেন মুনাফাখোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ইলিশের দাম কেমন হবে তা সকালে নির্ধারণ করে দেয় মোকাম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বিক্রি না হলে তা ফ্রিজিং করে রাখা হয়।
প্রতি ইলিশে লাভ ৭০০ টাকা পর্যন্ত : ভরা মৌসুমের পরও বাজারে ইলিশের অতিরিক্ত দামের জন্য সম্প্রতি অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে দেখা যায়, আড়তদারদের কাছ থেকে দেড় হাজার টাকায় কেনা ইলিশ বিক্রেতারা ভোক্তার কাছে বিক্রি করছেন ২ হাজার ২০০ টাকায়। অর্থাৎ একটি ইলিশেই ৭০০ টাকা পর্যন্ত লাভ করছেন ব্যবসায়ী। ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে দেশের বিভিন্ন ইলিশের বাজার ও আড়তে অভিযানে নামে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ঢাকার কারওয়ান বাজার ও যাত্রাবাড়ীর পাইকারি মাছের আড়তে অভিযান চালায় প্রতিষ্ঠানটির দুটি বিশেষ টিম। অভিযানে ইলিশ বিক্রির আড়তে মাছ ক্রয়সংক্রান্ত কোনো প্রকার তথ্য বা ক্যাশ মেমো পাওয়া যায়নি। পাইকারিতে ১ হাজার ৪৫০ টাকা কেজি দরে ইলিশ মাছ কিনে খুচরা ২ হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়েছে। এমন অপরাধে পাঁচ আড়তদারকে ৪২ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে চালানো অভিযানে দেখা যায়-মনপুরা, ভোলা, মহীপাল, ফেনী, চাঁদপুর ও পাথরঘাটা থেকে ইলিশ মাছ যাত্রাবাড়ী বাজারে আসে। ১ কেজি ৫০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ ১ হাজার ৮০০ টাকা প্রতি কেজি, ১ কেজি সাইজের ইলিশ ১ হাজার ৬০০ টাকা প্রতি কেজি, ৮০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ৪৭০ টাকা প্রতি কেজি, ৫০০ গ্রাম সাইজের ইলিশ ৯০০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি পর্যায়ে। কমিশন এজেন্ট ৩ শতাংশ হারে রাখা হচ্ছে। তবে কোনো ব্যবসায়ী পাকা রসিদ সংরক্ষণ ও সরবরাহ করছেন না। মূল্য তালিকাও প্রদর্শন করা হচ্ছে না। ভারতে ইলিশ মাছ রপ্তানির খবরেও ব্যবসায়ীরা অযৌক্তিকভাবে কেজিপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা দাম বাড়িয়ে দেন বলে জানা যায়।
তিন-চার হাত বদলে ভোক্তার কাছে পৌঁছে ইলিশ : বরিশাল প্রতিনিধির পাঠানো তথ্যে, জেলেদের ধরার পর অন্তত তিন-চার হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায় ইলিশ মাছ। প্রতি হাত অন্তত ১০০ টাকা লাভ রাখায় মূল দামের চেয়ে ভোক্তাকে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হয়। মেঘনা নদীর বরিশালের হিজলা উপজেলার বাসিন্দা জেলে হাসান হাওলাদার জানান, তারা নদী থেকে মাছ ধরার পর ঘাটে নিয়ে আসেন। সেখানে পাইকাররা ডাক দিয়ে মাছ কিনে নেন। এখানে মাছের সাইজ এবং ওজন ভেদে কোনো ভাগ করা হয় না। সব মাছ একসঙ্গে রাখা হয়। পাইকাররা মাছের মধ্যে ১ কেজি কিংবা তার চেয়ে ছোট মাছ কয়টি আছে, জাটকা কী পরিমাণ তা দেখেন। পরে খুচরা বাজারে যে দামে বিক্রি হয় তার চেয়ে অন্তত ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কম ধরে দাম হাঁকেন। খুচরা বাজারে ১ কেজি সাইজের ইলিশ যদি ১২০০ টাকা হয়, তাদের কাছ থেকে ৮০০ টাকা দরে কেনেন। ওই মাছ কিনে তারা ঢাকা, চাঁদপুর, বরিশালের বিভিন্ন মোকামে নিয়ে যান। সেখান থেকে অন্য পাইকাররা কিনে নেন। দেশের বিভিন্ন বড় বাজারের পাইকররা সেখান থেকে কিনে নেন। তাদের কাছ থেকে কিনে নেন খুচরা বিক্রেতারা। তাদের কাছ থেকে কেনেন ভোক্তারা। প্রতিটি হাত সর্বনিম্ন ১০০ টাকা লাভ করে। মেঘনা নদীর তীরের মাছঘাটের মালিক আলতাফ জমাদ্দার বলেন, ‘জেলেরা আমাদের কাছ থেকে দাদন নেন। নদী থেকে মাছ শিকারের পর আমাদের ঘাটে নিয়ে আসেন। ঘাটে থাকা পাইকাররা দাম হাঁকেন। জেলেদের পছন্দ হলে বিক্রি করেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’ একই কথা বলেন বরিশাল সদর উপজেলার লাহারহাট এলাকার বেদে সরদার মো. জসিম। তিনি বলেন, ‘আমরা মাছ ধরে বাজারে নিয়ে যাই। সেখানে থাকা পাইকার ঠিকা (অ্যাভারেজ) দাম হাঁকেন। পছন্দ হলে দিয়ে দিই।’ জসিম সরদার বলেন, তাদের কাছ থেকে পাইকাররা কেজি দরে মাছ ১৩০০ থেকে ১৪০০ টাকা, কেজির নিচে এলসি সাইজ ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা, আধা কেজি ওজন সাইজ ১ হাজার টাকা ও জাটকা ৩০০ টাকা দরে কিনে নেন। গত শুক্রবার বরিশাল নগরীর পোর্ট রোড বাজারে পাইকারিতে ১ কেজি সাইজের ইলিশ মাছ ১৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। খুচরা বাজারে তার দাম ছিল ২ হাজার টাকা। এলসি সাইজ পাইকারিতে ১৭০০, যা খুচরা বাজারে ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। পাইকারি বিক্রেতা নাইম সিকদার বলেন, বর্তমানে বাজারে ইলিশ মাছ নেই, তাই দাম বেড়েছে।
ঢাকা-পশ্চিমবঙ্গের ব্যবসায়ীরা চড়া দামে মাছ নিচ্ছেন : দেশের সর্বাধিক ইলিশ আহরণ হয় কক্সবাজারের বঙ্গোপসাগর উপকূলে। গত এক সপ্তাহে জেলেদের জালে অন্তত ৭৪৩ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়েছে। তবে এর পরও স্থানীয় বাজারে রয়েছে ইলিশের সংকট, যার কারণে বেশি দামে ইলিশ কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত এক সপ্তাহে কক্সবাজার উপকূল থেকে ৩ হাজার ৭১১ মেট্রিক টন সামুদ্রিক মাছ আহরণ করা হয়। এর মধ্যে ইলিশ ৭৪৩ মেট্রিক টন। খুচরা মাছ ব্যবসায়ী মো. হোছনের সঙ্গে কথা হয় মৎস্য কেন্দ্রে। তিনি বলেন, তিন হাত বদলে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বাড়িয়ে ইলিশ বিক্রি হয়। বোট থেকে আড়তদার ১ কেজি সাইজের ইলিশ কেনেন ১৫০০-১৬০০ টাকায়, যা পরে পাইকারকে ১০০-১৫০ টাকা লাভ ধরে বিক্রি করেন ১৭০০-১৮০০ টাকায়। সেভাবেই দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে ২০০-৩০০ টাকা বাড়তি আদায় করে ব্যবসায়ী-আড়তদার সিন্ডিকেট। বিক্রেতারা বলছেন, বছরের এ সময় ইলিশের দাম কিছুটা পড়তির দিকে থাকার কথা, কিন্তু দাম কমছে না। মূলত ঢাকা ও পশ্চিমবঙ্গের বড় মাছ ব্যবসায়ীরা চড়া দামে ইলিশ নিয়ে যাচ্ছেন। এতে স্থানীয় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম।
খরচ জোগাতে দাম বেড়েছে : ইলিশের ভরা মৌসুম হলেও নদনদীগুলোয় পর্যাপ্ত ইলিশ না পাওয়ায় চাঁদপুরের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র বড় স্টেশন মাছঘাটের আড়তে বাড়েনি সরবরাহ। চাহিদা বেশি ও সরবরাহ কম থাকায় প্রতি কেজি ইলিশের দাম একটু বেশি। অন্যান্য সময়ের তুলনায় প্রতি কেজিতে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি। ফলে আড়তে ক্রেতার চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সরবরাহের কারণে বাজারে ইলিশের দাম বেশি বলে ব্যবসায়ীরা জানান। চাঁদপুর মৎস্য আড়তে যেখানে অন্যান্য বছর প্রতিদিন ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার মণ ইলিশ আমদানি হতো, সেখানে এ বছর ৩০০ থেকে ৫০০ মণ আমদানি হচ্ছে। চাঁদপুরে বর্তমানে ১২০০ থেকে ১৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ ২১০০ থেকে ২৩০০ টাকা, ১ কেজি ইলিশ ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের অভিযোগ, বছরের এই সময় ইলিশ কিনতে ঢাকাসহ সারা দেশ থেকে অনেকেই ভিড় জমান চাঁদপুরে। ইলিশের গ্রাহক বেড়েছে, কিন্তু সরবরাহ কম এজন্য দাম বেশি। চাঁদপুরের জেলে লিটন গাজী ও সফিক আকন্দ জানান, নৌকা নিয়ে নদীতে নামলেই জ্বালানি খরচ ও খাওয়া মিলে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা খরচ হয় । এ বছর আহরণকৃত ইলিশের সাইজ খুব ছোট। তাদের এমনও দিন যায় ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মাছ আড়তে বিক্রি করে থাকেন। তাঁরা বলেন, ‘আগে নদীতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার আড়ত করতাম, তাতে ভালোভাবেই সংসার চালাতাম। এখন সে অবস্থা নাই।’ আড়তদার শাহজাহান গাজী ও খলিল শেখ বলেন, ইলিশের জাল, নৌকা তৈরি করতে বেশির ভাগ পুঁজি আড়তদাররা বিনিয়োগ করেন। জেলেরা ইলিশ ধরে আনার পর বিক্রির শতকরা ৫ টাকা আড়তদার পেয়ে থাকেন। এমনও দিন যায়-জেলেরা যে পরিমাণ ইলিশ পান তা বিক্রির টাকা দিয়ে নৌকার জ্বালানি খরচ গিয়ে কিছুই থাকে না।
মাছ কম ওঠায় দাম বেশি : ইলিশের জেলা খ্যাত উপকূলীয় বরগুনা দেশে ইলিশের চাহিদার ৭৫ ভাগ পূরণ করে এলেও সাগর ও বিষখালী, বুড়ীশ্বর আর বলেশ্বর নদে ইলিশ আহরণ কম হওয়ায় বিগত বছরের তুলনায় দাম বেশি। সাগর বা নদীতে ইলিশের উপস্থিতি অনেক কমে গেছে। আগে ১০টি ট্রলার বোঝাই করে মাছ এলেও এখন ১০টির মধ্য দুটি ট্রলার মাছ পাচ্ছে, আটটিই খালি ফিরছে। বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের জেলে শ্রমিকনেতা আবদুল মন্নান বলেন, বিগত বছরে যেমন একসঙ্গে সাগর থেকে ২৫-৩০টি ট্রলার বোঝাই করে টন টন ইলিশ আসত, যা দিয়ে চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত থাকত; সেখানে এ বছর ১০টি ট্রলারের মধ্য দুটিতে ৫-৬ মণ মাছ আসছে। বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের ব্যাবস্থাপক লে. কমান্ডার জি এম মাসুদ সিকদার বলেন, সাগরে ইলিশ কম আহরণ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে দাম বেড়ে গেছে।
হাত বদলে দাম বাড়ে : এ মৌসুমে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না বলে দাবি পটুয়াখালীর ট্রলার মালিক ও আড়তদারদের। আবার বড় সাইজের ইলিশও পাওয়া যায় না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও জেলেরা। গভীর সাগরে ইলিশ শিকারি জেলে আজমল হোসেন জানান, গভীর সাগরে লাল জালে এবার ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে খুবই কম। মহীপুর মৎস্যবন্দরের ব্যবসায়ী গাজী ফিশের মালিক মজনু গাজী জানান, এ বছর সাগরে ইলিশ নাই বললেই চলে। যা-ও দু-একটি ট্রলারে অল্প ইলিশ পাওয়া যায় তার দামও চড়া। তিনি জানান, গত মৌসুমে একেকটি ট্রলার ৩০-৪০ লাখ এমনকি একটি ট্রলার ৬০ লাখ টাকারও ইলিশ বিক্রি করেছে। বেশির ভাগই গভীর সাগরে লাল জালে প্রচুর মাছ পেয়েছে। এ বছর লাল জালে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। লম্বা জালে কিছু ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। তার দাম অনেক বেশি। কেজি আপ (ওপরে) ইলিশ প্রতি মণ ৬৫ হাজার টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৫৫ হাজার টাকা, ৫০০-৬০০ গ্রাম ইলিশ প্রতি মণ ৪০-৪৫ হাজার টাকায় পাইকারি বিক্রি হয়। এর চেয়ে ছোট সাইজের ইলিশ গড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়। গদির মালিকরা শুধু আড়তদারি পান। ইলিশগুলো পাইকারি বিক্রির পর কোথায় যায়-এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এখানে পাইকাররা উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে ইলিশ কেনার পর প্রথমে তাঁরা হিমায়িত প্যাকেটজাত করেন। এরপর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উত্তর, পশ্চিম ও মধ্যাঞ্চলের বাজারগুলোয় বিক্রি করেন। সেখানে বাজার মূল্যের ওপর বা পাইকারের ডাকের ওপর মাছের দর ওঠানামা করে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, একবার লোকসান হলে পরবর্তী ট্রিপে সে টাকা ওঠানোর চেষ্টা করার ফলে দাম চড়া হয়। দু-তিন বার কোনো কোনো ক্ষেত্রে চারবার হাতবদলের ফলে দাম তো বাড়বেই।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বরিশালের নিজস্ব প্রতিবেদক সাইদ মেমন, কক্সবাজার প্রতিনিধি আয়ুবুল ইসলাম, চাঁদপুর প্রতিনিধি নেয়ামত হোসেন, বরগুনা প্রতিনিধি মো. হাসানুর রহমান ঝন্টু ও পটুয়াখালী প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার দাস]