সোমবার, ১২ মার্চ, ২০১৮ ০০:০০ টা

ব্যাটিং শিল্পী মুশফিক

আসিফ ইকবাল

ব্যাটিং শিল্পী মুশফিক

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ইতিহাস গড়া ইনিংস খেলা নির্ভার মুশফিক ঘুরে বেড়িয়েছেন কলম্বোয় বিভিন্ন ঐতিহাসিক জায়গায় —ইন্টারনেট

একশ, দু’শ বছর নয়, ইতিহাসটা আরও আগের। হাজার-দেড় হাজার বছরের পুরনো। গাঙেয় ব-দ্বীপের কোনো এক অঞ্চলের রাজা বিজয় সিংহ। হঠাৎ তার মনের খেয়াল ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জয় করবেন নারিকেল ঘেরা ছোট্ট দেশটি। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। সমুদ্র ঘেরা ধনসম্পদে ভরা দেশটি জয় করে নেন হেলায় ফেলায়। রাজা হয়েই রাজ্যের নাম রাখেন সিংহল। বাংলা থেকে হাজার মাইল দূরের সিংহল দখল করায় বিজয় সিংহের গুণগান গেয়ে কবি দ্বীজেন্দ্র লাল রায় লিখেন অমর কবিতা-

‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয় একদা যাহার অর্ণবপোত ভ্রমিল ভারত সাগরময়।’

হাজার বছর আগের সিংহল এখন শ্রীলঙ্কা। রাজা বিজয় সিংহ নেই। কিন্তু এখনো ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন তিনি। বিজয় সিংহের সিংহল জয়ের হাজার বছর পর আরও এক বাঙালি জয় করলেন দ্বীপরাষ্ট্রটি। এবার সিংহলবাসীর বক্ষ বিদীর্ণ করে, লাল-সবুজ পতাকা উড়ালেন মুশফিকুর রহিম। মুশফিক শ্রীলঙ্কা জয় করেন ব্যাট হাতে দুর্দমনীয় এক ইনিংস খেলে। শনিবার রাতে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট যোদ্ধার পোশাকে জয় করেন শ্রীলঙ্কা। জয় করেন ১৬ কোটি ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালির হৃদয়। ২১৫ রানের পর্বতসমান স্কোর তাড়া করতে নেমে ৩৫ বলে ৭২ রানের যে বীরত্বমাখা ইনিংসটি খেলেন মুশফিক, সেটার তুলনায় হাজার বিশেষণও যেন অপ্রতুল! এ এমন এক ইনিংস, যা চিরস্থায়িত্ব পেয়েছে ক্রিকেট ইতিহাসের সোনালি পাতায়। দুর্দান্ত, দুরন্ত এক ইনিংস খেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটে অমর হয়ে গেছেন মুশফিকুর রহিম। ‘মি. ডিপেন্ডেবল’ মুশফিক গতকাল খেলেন হাজার কোটি টাকা দামের বীরত্ব মাখা ইনিংস। যার নেই কোনো তুল্যমূল্য বিচার।

সময়টা ভালো কাটছিল না বাংলাদেশের। যদিও বছরটা শুরু হয়েছিল অসাধারণ এক জয়ে। এরপর ছন্দপতন। ‘জয়’ শব্দটি স্মৃতি হয়ে উঠছিল দিন দিন। তখনই খেললেন মুশফিক। খেলালেন বাংলাদেশকে এবং উপহার দিলেন ঐতিহাসিক জয়।

১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ রাজের কাছ থেকে মুক্তি পায় একদার সিংহল, আজকের শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আগে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটি বাংলাদেশ ও ভারতকে নিয়ে আয়োজন করছে তিন জাতির নিদাহাসা টি-২০ টুর্নামেন্ট। টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচে অসহায় হয়ে হেরে যায় টাইগাররা। জাত গেল, মান গেল বলে সমালোচকরা সমালোচনায় বিদীর্ণ করছিলেন ক্রিকেটারদের। ক্রিকেটারও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন নিজেদের এমন ছন্নছাড়া পারফরম্যান্সে। নিজেদের খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেন ক্রিকেটাররা। প্রমাণের মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন শ্রীলঙ্কাকে। লিখেন নতুন ইতিহাস। অবাক করেন ক্রিকেট বিশ্বকে।

ভারতকে হারিয়ে হাওয়ায় ভাসছিল চন্ডিকা হাতুরাসিংহের শ্রীলঙ্কা। অপরদিকে ভারতের কাছে হেরে কোণঠাসা হয়েছিল বাংলাদেশ। এমন সমীকরণের বাতায়নে প্রেমাদাসায় প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ২১৪ রানের পর্বতসমান স্কোর করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের বিপক্ষে যা যে কোনো দেশের দ্বিতীয় এবং শ্রীলঙ্কার সর্বোচ্চ স্কোর। এছাড়া ইতিহাস বলে যেখানে দুইশ রানের কোনো স্কোর নেই টাইগারদের, সেখানে ২১৫ রান তাড়া করে ম্যাচ জেতা স্বপ্ন দেখারই নামান্তর। কিন্তু বিজয় সিংহের উত্তরসূরিরা স্বাধীনতার মাসে আরও একটি বিজয় দিয়ে দেশবাসীকে রংধনুর সাত রঙে সাজাতে ছিলেন মরিয়া। সেই ক্রিকেটযুদ্ধ জিততে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন মুশফিক। দুই বছর আগে টি-২০ বিশ্বকাপে ৩ বলে এক রান নিতে না পারায় ‘খলনায়ক’ পরশু রাতে নিস্তবতা এনে দেন শ্রীলঙ্কায়। শ্মশানে পরিণত করেন প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামকে। দলকে ভুলে জয়ের স্বাদ দিতে ব্যাটকে খাপ খোলা শানিত তলোয়ার বানিয়ে এফোর-ওফোর করেন লঙ্কান ক্রিকেটের। ইতিহাসের পঞ্চম সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতার রেকর্ড গড়তে মুশফিক খেলেন ৩৫ বলে ৭২ রানের দৃষ্টিনন্দন এক ইনিংস। তাতে ছিল ৪টি ছক্কা ও ৫টি চার। ক্রিকেট পরিসংখ্যানে এসব শুধুই সংখ্যা। সাদা কাগজে কালো হরফে সেটাই লেখা থাকবে আজীবন। কিন্তু জয়টি, ইনিংসটি ক্রিকেট আবেগে ভেসে যাওয়া বাংলাদেশের জনতার কাছে একটি স্বপ্ন, একটি উৎসব, একটি উচ্ছ্বাস ও ভালোবাসার নাম। ২০১৬ সালে ব্যাঙ্গালুরুতে শেষ তিন বলে ১ রান নিতে পারেননি মুশফিক, মাহমুদুল্লাহ। হেরে যায়। এরপর থেকেই গত দুই বছর ম্যাচটি দুঃস্বপ্ন হয়ে তাড়িয়ে বেরিয়েছে মুশফিককে। ওই ম্যাচের ফল নিয়ে কতটা চাপে ছিলেন সাবেক অধিনায়ক, পরশু রাতে অবিস্মরণীয় জয়ের পর বুনো উল্লাসই তার প্রমাণ। তিনি যখন ক্রিজে আসেন, তখন জয়ের জন্য দলের প্রয়োজন ছিল ৬৩ বলে ১১৫ রান। সেই অবিশ্বাস্য কাজটিই করেন হারকিউলিস তেজে ব্যাটিং করে। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এটা সেরা জয় কি না, প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে মুশফিকের ইনিংসটি যে বাংলাদেশের সেরা, এ নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। ম্যাচ শেষে মিডিয়ার মুখোমুখিতে বাংলাদেশের বহু ম্যাচ জয়ের নায়ক তামিম ইকবাল ইনিংসটিকে বাংলাদেশের সেরা বলে সোজাসাপ্টা স্বীকার করেই নিয়েছেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর