২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২০ ১৪:০৭
পঞ্চম পর্ব

বনবিহারী

আলম শাইন

বনবিহারী

দ্বীপ বনে পঞ্জিকা আর ক্যালেন্ডারের পাতার ভূমিকা অপরিসীম। এখানে ফোন নেটওয়ার্ক অকার্যকর। জনবসতি রয়েছে দ্বীপের যেই খণ্ডে সেখানে মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক আসা যাওয়া করলেও কথাবার্তা বলা যায় না তেমন একটা। আর সংবাদপত্রও পড়ার সুযোগ নেই; রেডিও শোঁ শোঁ আওয়াজ করে। দেশে কখন কী ঘটছে তা-ও জানতে পারছি না। সম্পূর্ণ অনুমান নির্ভর আমাদের জীবনযাত্রা। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় আবহাওয়ার পূর্বাভাস নিয়ে। সিগন্যাল না থাকলে বিপাকে পড়তে হয় আমাদের। বোঝার উপায় নেই ঘূর্ণিঝড় বইবে কী বইবে না অথবা গতিবিধি কী ধরনের হতে পারে তাও জানার উপায় নেই। সমুদ্রের রুদ্ররোষের ওপর আন্দাজ করে বের করি ঝড়ের পূর্বাভাস কেমন হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়া মুহূর্তের সমুদ্র দর্শনে আমাদের খানিকটা অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় হয়েছে। যদিও আন্দাজের হেরফের হয়, তথাপিও ঝড়ঝঞ্ঝা মোকাবেলার বা প্রস্তুতির সুযোগ হয় কিছুটা।

প্রবল ঘূর্ণিঝড় অথবা জলোচ্ছ্বাস হলে দ্বীপ বন তলিয়ে যায়। তবে আমাদের বাসস্থান অনেকটা উঁচু বিধায় সাইক্লোন সেন্টারের মতো কাজে দেয়; সুরক্ষা পেয়ে যাই তাতে। হাতিটাকে নিয়ে একটু বিপত্তি হয় বৈকি। সেজন্য হাতি যেখানে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে গাছের গুঁড়ির ওপর মাটি ফেলে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে। হাতি যেন উঠতে পারে সেই জন্যে কিছুটা দূর থেকে ঢালু করে উচ্চতা তৈরি করা হয়েছে। তাতে ফুট পাঁচেক পর্যন্ত উঁচু হয়েছে। অপরদিকে হাতির উচ্চতা ত আছেই। সব মিলিয়ে হাতি নিরাপদে থাকতে পারে এখন।

দ্বীপ বনে আসার পর ২-৩ বার ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসের মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি। সমস্ত দ্বীপ বন জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে যেতে দেখেছিলাম। যদিও জল দ্রুতই নেমে গেছে, সমুদ্র সন্নিকটে বিধায়। তথাপিও ভীষণ সমস্যা হয়েছে প্ল্যান্টের ভেষজ উদ্ভিদগুলোর। সেই ক্ষতি পোষাতে কোম্পানির খানিকটা বেগ পেতে হয়েছে। নোনাজল সহ্য করতে না পারা আষাঢ়ী লতা, বিকাশ লতা, রক্তকুঁচ, বন টেপারি আর গোল মরিচের লতাগুলো প্রাণ হারিয়েছে। প্রাণ হারিয়েছে আরও অনেক প্রজাতির ভেষজ গুল্মলতাও।

দ্বীপে বনের জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হওয়ায় অনেক কিছুই সহজ মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। আসলে এখানকার জীবনযাত্রা তত সহজ নয়, অত্যন্ত কঠিন। লোকালয় থেকে হঠাৎ করে কেউ এলে তার পক্ষে এখানে কাটানো সম্ভব নয়, মনে হবে দুর্গম বন্দীশালায় আছেন। আসলে প্রথম প্রথম সবারই অমন হয়। ধীরে ধীরে জঙ্গলের মায়া পেয়ে বসলে তখন আর ছেড়ে যেতে মন চায় না কারোই। সে ধরনের প্রমাণ আমি নিজেই। প্রথম দিকে কী যে কষ্ট, আর যন্ত্রণা ভোগ করেছি তা বলে শেষ করার নয়, কিন্তু মাস খানেক কেটে যেতেই বুঝতে পারলাম এ জীবনের মতো আনন্দদায়ক আর কিছুই নেই। রোমাঞ্চকর এক জীবন! এখানে ঘুম থেকে জেগে দেখি নিম, নিশিন্দা, হরিতকি, বয়রার মিলনমেলা। নদীর তীরে দেখি মাছরাঙা, পানকৌড়ি, ধলা বক, চিল আর জঙ্গলে দেখি কাঠ কুড়ালি, হরিয়াল, বসন্ত বউরির ব্যস্ত আনাগোনা। নদীর তীরে দাঁড়ালে দেখি তেজোদীপ্তমান সূর্যের অকাল মৃত্যু; জন্মাতেও দেখি সমুদ্র সৈকতে দাঁড়ালে। রাতের আকাশে দেখি অসংখ্য নক্ষত্ররাজি; গাছ-গাছালির ফাঁকফোকর গলিয়ে উঁকি দেওয়া চন্দ্রের গোলগাল হাস্যজ্জ্বল মুখটিও দেখি। কী যে চমৎকার সেই চন্দ্রমুখ, যেই মুখ দর্শনে প্রিয় মানুষটির কথাও মনে পড়ে যায়। তিনিও চন্দ্রপ্রেমিক ছিলেন, তাই আমি তাকে ‘চন্দ্রমুখী’ বলে ডাকতাম। তিনি তিথিগুলোতে চন্দ্রদোয়ের প্রতীক্ষায় থাকতেন; পূর্ণিমায় পুলকিত হতেন খুব। আজ তিনি নেই, অথচ চন্দ্রের যাতায়াত অব্যাহত রয়েছে ঠিকই। সবই প্রকৃতির খেলা। সেরকম এক খেলার গুটি হচ্ছে মানুষ, যে মানুষ একবার অস্তমিত গেলে আর উদয় হয় না, অপরদিকে নক্ষত্ররাজি অস্তমিত হলেও পুনরুত্থান ঘটান তিনি। ভীষণ সেই দর্শনতত্ত্ব বোঝার ক্ষমতাই বা রাখেন ক’জনায়?

যে কথা বলছিলাম, দ্বীপ বনে স্থায়ী হলেও দেশের খবরাখবর জানতে চেষ্টা করি সব সময়, পুরাতন সংবাদপত্রের মাধ্যমে। যখন আমাদের কেউ উপজেলা সদরে যান তখন পুরাতন সংবাদপত্র কেজিধরে ক্রয় করিয়ে আনাই। প্রতিমাসে অন্তত একবার এই সুযোগ হয় সংবাদপত্র সংগ্রহের। মাসকাবারি বাজার, ওষুধপত্র এবং প্ল্যান্টের চিঠিপত্র সংগ্রহ করতে পাঠাতে হয় লোকজন। সেসুবাদে যা কিছু পড়াশুনার সুযোগ হয় আমাদের। অর্থাৎ মাসখানেক পরে জানতে পারি আমরা দেশের খবরাখবর।

আর সৌরজগতের টুকিটাকি পঞ্জিকার মাধ্যমে পেয়ে থাকি। পঞ্জিকার পাতায় আমি পূর্ণিমার তিথিগুলো লালকালি দিয়ে দাগিয়ে রাখি। তার পর পূর্ণিমার তিথিতে গভীর রাত পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে কাটিয়ে আসি। যেই রাতে সৈকতে বিচরণ করার ইচ্ছে রাখি সেদিন সকালে মহব্বত দয়ালকে বলে রাখি আগে থেকেই। তাকে ছাড়া সৈকতে যাওয়ার চিন্তাই করতে পারি না। বিশেষ করে গভীররাতে ফেরার সময় দোনালার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় সঙ্গীরও। দোনালা সঙ্গে নিতে সংকোচবোধ হলেও নিতে হয় বাধ্য হয়েই, অন্যথায় বিপদ। অর্থাৎ দোনালাসহ মহব্বত দয়ালকে সঙ্গে চাই-ই চাই আমার। অন্য কাউকে সঙ্গে নিতে পারি, সে ক্ষেত্রে তাদের মনের ওপর চাপ পড়ে বুঝতে পারি। মহব্বত দয়াল বন, সমুদ্র ভালোবাসেন, ভালোবাসেন গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালিও। সে হিসেবে আমি মনে করি তাকেই আমার প্রয়োজন। কারোর মনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আমি রাজি নই, এ ব্যাপারে আমি সর্বদাই সতর্ক থাকি।

মহব্বত দয়াল এমন এক মানুষ রাতবিরাতে বনবাদাড়ে পাখিদের আর্তচিৎকারে যার কানখাড়া হয়ে যায়। তখন আমাকে বলেন ,‘বড়মিয়া পাখিটা বিপদে পড়েছে মনে হয়। কী করা যায়।'

আমি বলি, ‘আগে শোন আওয়াজটা অফিসচত্বরের কাছাকাছি কীনা। যদি কাছাকাছি হয় তাহলে টর্চ নিয়ে বের হও, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।’

এই হচ্ছে মহব্বত দয়ালের প্রকৃতিপ্রেমের খণ্ডচিত্র। ফলে সঙ্গী হিসেবে সে অতুলনীয় তা বলতে পারি। তাই প্রতি পূর্ণিমারাতে সঙ্গী করে নেই মহব্বত দয়ালকে। কয়েক বছর আগে তাকে নিয়ে সৈকত থেকে ফেরার পথে রোমহর্ষক এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেই ঘটনাটাই জানাচ্ছি এখন।

পঞ্জিকা মোতাবেক সেদিন পূর্ণিমার তিথি। সকাল ১০টা নাগাদ মহব্বত দয়ালকে বললাম, ‘আজ রাতে সৈকতচারি হবো। সঙ্গে থাকছো ত?’

সে বলল, ‘বলেন কী, বড়মিয়া, আমি আপনার সঙ্গে থাকবো না, এটা কি হয়? এখন বলেন কী ধরনের খাবার নিবো সঙ্গে।’

বললাম, ‘শুধু গোলআলু পোড়া হলেই চলবে, লবণ মাখিয়ে খাব। আর বোতলে ফুটানো পানি ভরে নিও।’

মহব্বত দয়াল বললেন, ‘বড়মিয়া আলুরদম বানালে কেমন হয়? খেতে মজা লাগবে।’

বললাম, ‘সে তোমার ব্যাপার, যা ভালো হয়, তা-ই করো।’

কথা শেষ, মহব্বত দয়াল তার কাজকর্মে মনোযোগী হলেন। আমিও প্রাত্যহিক কাজকর্মে মনোনিবেশ করলাম। আমর কাজ ঘুঁটিয়ে নিতে নিতে দুপুর গড়িয়ে গেল। স্থির করলাম আমরা সাড়ে চারটার মধ্যেই রওয়ানা দিব। দেরি হলে পর্যটকদের সঙ্গে দেখা হবে না। এখানে প্রতিদিন ২০-২৫ জন পর্যটক আসেন, তাদের সাক্ষাৎ পেলে মন্দ লাগে না, বেশ ভালো লাগে। দীর্ঘদিন পর বাইরের লোকজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হলে আবেগতাড়িত হই, নিজকে ধরে রাখতে পারি না আর, আগ বাড়িয়ে কথা বলি, তাতে খুব শান্তি পাই। এই জন্য সূর্যাস্তের আগেই সৈকতে যাওয়ার চিন্তা করছি। কারণ এখানে সূর্যাস্তের পর তেমন কেউ আর থাকেন না।

দ্বীপ বন থেকে সৈকতের দূরত্ব তেমন বেশি না হলেও বনবাদাড় পেরিয়ে যেতে একটু সময় লাগে। পায়ে হেঁটে যেতে হয়, তাতে ঘণ্টা খানেক সময় লেগে যায়। বিশেষ করে কয়েকটা সরু খাল পেরুতে হয়। সে জন্য রাতবিরাতে এই পথে যাতায়াত সুবিধের নয়। যদিও খালগুলোর ওপর সাঁকোপাতা থাকে তথাপিও নিরাপদ নয়।
খালের ওপর যেই সাঁকোপাতা থাকে তা বাঁশ অথবা কাঠের পাটাতনের নয়। এই সাঁকোগুলো প্রকৃতি প্রদত্ত।
কেওয়া গাছের সাঁকো। অর্থাৎ খালপারের কেওয়া গাছগুলো হেলে পড়লে আর তোলা হয় না। লোকজন যাতায়াত না করলেও ওইভাবেই পড়ে থাকে। এটি বনবিভাগের সম্পদ। সর্বসাধারণ নেওয়ার আধিকার রাখে না। অবশ্য নেওয়ার মতো লোকজনও নেই এখানে। ফলে একেকটা খালে এরকম অসংখ্য সাঁকো নজরে পড়ে।

এই সাঁকোগুলো পেরুতে একটু সতর্ক হতে হয় নচেৎ বিপদ আছে, পা ফসকে পড়লে জলকাদায় মাখামাখি। আবার কাটা ছেঁড়ারও ভয় থাকে। দ্বীপ বনের চারপাশেই নদী-খাল আর তার ওপর অসংখ্য সাঁকো। সাঁকোগুলো বেশ নান্দনিক। আস্ত গাছ শুয়ে আছে শুকনো খটখটে ডালপালা বিস্তার করে। সাঁকোগুলোতে অসংখ্য ধলাবক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা বসে থাকে শিকারের প্রতীক্ষায়; সেই দৃশ্য মনকেড়ে নেয় সবার। মনকেড়ে নেয় কাশের বিস্তৃতিও। এসবের প্রতি আমার খুব আগ্রহ, তাই একটু জলদি জলদি বাংলো থেকে বেরুতে চাই।

পরিকল্পনা মোতাবেক দুপুরের খাবার খেয়ে গড়াগড়ি দিতে লাগলাম। এরইমধ্যে মহব্বত দয়াল আমার কামরায় হাজির হলেন, দোনালা, ওয়াকিটকি, টর্চ আর জলখাবার নিয়ে। তার বেশভূষায় অভিভূত হলাম, মনে হচ্ছে সে শিকারে বের হচ্ছে। দূর দেশে যাবে; সেরকম প্রস্তুতি। আমি তার দিকে প্রশংসাসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম, কিছু বলতে চাইলাম। তার আগেই মহব্বত দয়াল বললেন, ‘বড়মিয়া, জীবন ত একটাই, তাই ভোগ করছি একটু। তাছাড়া জঙ্গলে ভোগ করারই বা কী আছে, একটু ফিটফাট হয়ে চলা ছাড়া।’

বললাম, ‘তোমার চালচলন আমার বেশ পছন্দ, তোমার উত্তরবঙ্গের ভাষাও চমৎকার, উচ্চারণও ভালো, কাজেকর্মে তো বটেই। সব মিলিয়েই তুমি আমার পছন্দেরই একজন।’

মহব্বত দয়াল কোনদিন এ ধরনের কথা আমার মুখে শুনেননি, আজ হঠাৎ শুনে খুব খুশি হলেন। আর আমার প্রতি তার ভালোবাসা ব্যক্ত করলেন মন থেকেই।

বাংলো থেকে বের হওয়ার আগে জিজ্ঞেস করলাম, ‘চায়ের ব্যবস্থা আছে?’

মহব্বত দয়াল বললেন, ‘ফ্ল্যাস্ক ভর্তি আদা চা নিয়েছি। যত ইচ্ছে গরম গরম খেতে পারবেন।’

প্ল্যান্টের দুইজন কর্মীকে জানিয়ে আমরা রওয়ানা হলাম নদীর পার ধরে। প্ল্যান্টের ভেতর দিয়েও যাতায়াত করা যায়, সেক্ষেত্রে দূরত্ব অনেক কম হলেও গুল্মলতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার কারণে হাঁটতে একটু বেগ পেতে হয়। নদীর পার ধরে হাঁটলে গুল্মলতা কম, কিন্তু হরেক গাছে ঠাঁসা। আবার হরিণের সাক্ষাৎ পাওয়ারও সুযোগ আছে। শেষ বিকেলে হরিণপাল খালপারের খোলাপ্রান্তরে কচিঘাস খেতে আসে, সে সুবাদে দেখার সুযোগ আছে।

দ্বীপ বন বেষ্টিত নদীগুলো অপেক্ষাকৃত সরু। অনেকটা চওড়া খালের মতো। তেমনি একটি নদীর পার ধরে আমরা হাঁটছি, বিকাশ লতা, আষাঢ়ী লতা, রক্তকুঁচের ফাঁকফোকর গলিয়ে। এসব লতাগুল্ম অধিকাংশ আমাদের লাগানো, মৌসুমে ভেষজ কাঁচামাল সংগ্রহ করি আমরা। প্ল্যান্টে যত ধরনের গুল্মলতা আছে সবচেয়ে চমৎকার ফল হচ্ছে রক্তকুঁচের। শিমের বিচির মতো ফলগুলো, ফলের ওপরের বাকলও শিমের মতো। ফলের রঙ অসাধারণ। অর্ধেক কালো বাকি অর্ধেক টকটকে লাল; রক্তপ্রবালের মতো; শক্তও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি রক্তকুঁচ ফলের ওজন অপরিবর্তনীয়। আর সবগুলো ফলের ওজন একই পরিমাপের হয়। তাই হয়তো স্বর্ণকারের দোকানে রক্তকুঁচের ফল পরিমাপক হিসাবে ব্যবহার করতে দেখা যায়। রক্তকুঁচে ফুল আসে শরতে; ফলও হয় এ সময়ে। তবে ফল পরিপক্ক হতে কিছুটা সময় লাগে। পাকতে পাকতে শীত মৌসুম এসে যায়। এখন কুঁচের শরীরে ফুল এসেছে। বেগুনিসাদা ফুলে ছেয়ে গেছে রক্তকুঁচের সমস্ত শরীর। দেখতে ভীষণ চমৎকার লাগছে। আরও চমৎকার লাগছে মৌমাছিদের মধু সংগ্রহের দৃশ্যে। মৌমাছিদের ঘরে ফেরার পালা এখন, ফুলের রসে শেষ চুমুক দিতে ব্যতিব্যস্ত শেষবেলায়। কুঁচ ফুলের সৌরভে মুগ্ধ হলাম। হালকা মিষ্টি সেই সৌরভ কাছাকাছি গেলেই কেবল নাকে ঠেকে। দূর থেকে কুঁচ ফুলের সৌরভ তেমন একটা নাকে লাগে না।

নদীর পার ধরে হাঁটার আরেকটি কারণও আছে। সেটি হচ্ছে এখন কাশমৌসুম, শরৎজুড়ে থাকবে শ্বেতশুভ্র কাশের নৃত্য। সেই নৃত্য উপভোগ করার মতোই, আর সেই মৌসুম এখনই; যা দেখে তৃপ্ত হই আমি। এ ছাড়াও সামনে মেঘনার মোহনা; মোহনার জলস্রোতও কম আকর্ষণীয় নয়। সাগরসঙ্গগমও দেখার সুযোগ আছে এই বন্ধুর পথেই। সব মিলিয়ে দারুণ অনুভূতির একযাত্রা। যেই যাত্রায় বিরক্তি নেই; উপভোগ্য।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা সৈকতে পৌঁছে গেছি সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই। সৈকতে পর্যটকদের তেমন মিলনমেলা নেই, দেখলাম ৮-১০ জন ঘোরাঘুরি করছেন। হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই তারাও চলে যাবেন; তখন আমি আর মহব্বত দয়াল সৈকতের জিম্মাদার। রাত এগারোটা নাগাদ আমাদের জিম্মায় থাকবে সৈকত, তার পর প্রকৃতির কাছে ফেরত দিয়ে বাংলোয় ফিরবো।

সূর্যাস্তের সামান্য পরে পূর্ব আকাশ আলোকিত করে মস্ত এক গোলাকার চাঁদের আবির্ভাব ঘটল। অন্যরাতের চাঁদের চেয়ে আজকের চাঁদ যেমন পরিপুষ্ট তেমনি ঝকঝকে উজ্জ্বলও। মুহূর্তেই আলোক জ্যোতিতে চারপাশ ফকফকা হয়ে গেল। আঁধার যত ঘনিভূত হচ্ছিল চন্দ্রজ্যোতির প্রখরতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। সৈকতময় এক জাদুকরী রাজ্যে পরিণত হয়েছে; সমুদ্র যেন এখন এক রূপকথার ক্ষীরসাগর। যে সাগরের ক্ষীর পায়েসের প্রলুব্ধতায় আমরা প্রাণবন্ত সময় কাটাচ্ছি।

রাত যত গভীর হচ্ছে, ততই রহস্যময়ী হয়ে উঠছে চন্দ্র। চন্দ্ররূপে অভিভূত হয়ে মোহগ্রস্তের মতো তাকিয়ে রইলাম আমি। এরিমধ্যে মহব্বত দয়াল বললেন, ‘বড়মিয়া, আলুরদম খাবেন?’
বললাম,‘দুই টুকরা দাও।’

মহব্বত দয়াল সঙ্গে নিয়ে আসা প্যাকেট থেকে খাবার বের করে খেতে দিলেন। সামান্য জলখাবার শেষে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম; তারি সঙ্গে উপভোগ করতে লাগলাম সমুদ্রের গর্জন, শোঁ শোঁ বাতাস আর উঁচুনিচু ঢেউয়ের তাণ্ডব।

রাত এগারোটা নাগাদ সৈকত ছেড়ে বাংলোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম আমরা। এবার প্ল্যান্টের ভেতর দিয়ে হাঁটছি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাংলোয় পৌঁছে যাব আশাকরি। এ পথে দূরত্ব কম। নদীরপার ধরে হাঁটা এখন নিরাপদ নয়, যদিও চলতি পথও নিরাপদ নয়। তথাপিও দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রয়াসে এ পথ ধরলাম।

চলতি পথের দু’ধারে গাছ-গাছালি আর লতাজঙ্গল হলেও হাঁটতে তেমন অসুবিধা হচ্ছে না। জোৎস্নাস্নানে সিক্ত হয়ে দু’জন পূর্ণিমার বনরূপ অবলোকন করে অগ্রসর হচ্ছি।


বনপ্রান্তরের পূর্ণিমা রহস্যময়ী হয় জানি, কিন্তু এতটা রহস্যময়ী হয় সেটি আগে জানা ছিল না। গাছ-গাছালির বিশাল ছায়া আর লতাগুল্মের ওপর ছড়িয়েপড়া চাঁদের ঠাণ্ডা আলোর স্রোতের প্রবাহে এক ইন্দ্রজালের সৃষ্টি করেছে যেন। বনময় নীরব নিস্তব্ধ এখন; দুই পাতার সামান্য সংঘর্ষও কানে পৌঁছে যাচ্ছে অনায়াসেই। দূরের লতাঝোঁপকে পাহাড় সাদৃশ্য লাগছে। মনটা উতাল পাতাল করছে সেই পাহাড় ছুঁইতে। মনের সংকল্প জানাতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রমুখীর কথা জানাতে।

ইতিমধ্যে প্রায় মিনিট বিশেক পথ হেঁটেছি আমরা। অমনি কানে এলো বুনো কুকুরের আর্ত চিৎকার! খুব কাছাকাছি না হলেও তেমন দূরেও নয় চিৎকারের উৎসস্থল। বিপদ সন্নিকটে, সেটি বুঝতে আর বাকি রইল না আমাদের। তাই সঙ্গে সঙ্গে ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়লাম, আর সামনে অগ্রসর হইনি। ক্রমশ আওয়াজ স্পষ্ট হচ্ছে, তার মানে কুকুরগুলো রাস্তাধরে আমাদের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। সামনে শিকার, সেই উদ্দেশ্যে নয়, চাঁদনী রাতে প্রশস্ত রাস্তাধরে ঘুরাফেরা করছে হয়তবা। অথবা শিকারের সন্ধানেও বের হতে পারে। ঠিক এমনি মুহূর্তে ওদের চলারপথে প্রতিবন্ধকতার  সৃষ্টি হলে পরিস্থতি ভয়াবহ হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। সেটি নির্ভর করবে ওদের সংখ্যার ওপরে। কারণ বুনো কুকুর সংখ্যায় যত বেশি হয় ততই হিংস্র হয়ে ওঠে। এখন ওরা সংখ্যায় কয়টি তা আমরা নিশ্চিত নই। অতএব আমরা ঝুঁকি নিতে রাজি নই, নিরাপদে থাকতে চাই।

আওয়াজ আরও স্পষ্ট হচ্ছে। তার মানে কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। উপায়ন্তর না দেখে মহব্বত দয়ালের কাছে জানতে চাইলাম, ‘গুলি কয়টা আছে দয়াল?’

মহব্বত দয়াল বললেন, ‘দুইটা।’

তার কথাশুনে আমার হাতেপায়ে কাঁপন ধরে গেল। দুই গুলি ফুটিয়ে পার পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া কোন কারণবশত যদি গুলি ব্যর্থ হয় তাহলে উপায় কী হবে! বিকল্প কিছু ভাবতে লাগলাম। পেছনে ফিরে যাব সেই ভরসাও পাচ্ছি না। কী করা যায় তাহলে?

কয়েক সেকেন্ড ভেবেচিন্তে স্থির করলাম গাছে চড়তে হবে। মহব্বত দয়ালকে বললাম, ‘জলদি একটা গাছে টর্চের আলো ফেল। দেখ সাপখোপ আছে কীনা গাছে।’

দ্বীপ বনের গাছের ডালপালায় কিংবা ঝোপজঙ্গলে প্রচুর সাপের বসতি। যখন তখন সাপের সাক্ষাৎ মিলে এখানে। রাতে সাপের উপদ্রব আরও বেড়ে যায় সুতরাং সাবধান হতে হবে।

মহব্বত দয়াল খুব দ্রুত চিকন আকৃতির একটা গাছ বাছাই করলেন, গাছটার ডালপালা নিচের দিকে ঝুলানো। তার পর টর্চের আলো জ্বেলে নিশ্চিত হলেন গাছটা নিরাপদ কীনা। যখন সম্পূর্ণ নিশ্চিত হলেন তখন আমাকে গাছে চড়তে সিগন্যাল দিলেন।

আমি গাছে চড়তে অভ্যস্থ নই, তাই মহব্বত দয়াল পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে আমাকে ওপরে উঠিয়ে দিলেন। তার পর নিজে গাছে চড়ার উদ্যোগ নিতে নিতে বললেন, ‘বড়মিয়া, এবার একটা ফাঁকা আওয়াজ করি, আওয়াজ শুনলে আমাদের লোকজন চলে আসবেন।’

‘বুদ্ধিটা খারাপ না। গুলি ছুঁড়ে জলদি গাছে চড়। ওয়াকিটকি আমার হাতে দেও, লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি আমি।’

মহব্বত দয়াল মুহূর্তেই বন্দুক ওপরের দিকে তাক করে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লেন। বিকট আওয়াজ হয়েছে। সেই আওয়াজে বনপ্রান্তর কাঁপিয়ে ধ্বনি প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করল। কিন্তু তাতেও কুকুরের আর্তচিৎকার থামেনি; বরং ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। তার মানে কুকুরগুলো আরও কাছে এসে গেছে, আর ওরা গুলির আওয়াজে ভীতসন্ত্রস্ত হয়নি। মহব্বত দয়ালকে আর একসেকেন্ডও নিচে থাকতে দিলাম না। দ্রুত তাকে গাছে চড়তে নির্দেশ দিলাম। সে দ্রুত লাফ দিয়ে গাছে চড়েছে।

আমরা দুইজন একই গাছে চড়েছি, শক্ত মজবুত ভিন্ন ভিন্ন ডালে। ইতোমধ্যে ঘটনার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত চার-পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে আমরা নিরাপদে আশ্রয় নিতে সক্ষম হয়েছি।
কুকুরগুলো ধেয়ে আসছে সামনের দিকে। আমরা চুপচাপ বসে আছি। ওদের গন্তব্যে ওরা চলে যাক তার পরে সিদ্ধান্ত নিবো কী করার আছে আমাদের।

গাছে চড়ার মিনিটের মাথায় কুকুরগুলো আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। ভরা পূর্ণিমার ফর্সা আলোতে স্পষ্ট দেখলাম বুনো কুকুরের বিশাল একপাল চেঁচাতে চেঁচাতে গাছের নিচ দিয়ে দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে আমাদের পেছন দিকে। ভয়ে আমার শরীরের সমস্ত রোম শিউরে ওঠল। চোখ বন্ধ করে রাখলাম আমি, এই বুঝি নিচে পড়ে গেলাম। আমার চোখের সামনে ভাসতে লাগল সালেহ দেওয়ানের কঙ্কাল আর কুকুরগুলোর তীক্ষ্ণ দন্তপাটি।
কুকুরের পাল অনেক দূর চলে গেছে তার পরেও আমরা নিচে নামার সাহস পাইনি। বলা তো যায় না আবার যদি পেছন ফিরে।

গাছের ডালে বসেই ওয়াকিটকির মাধ্যমে অফিসের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাউকে পাচ্ছি না; এতরাতে পাওয়ার কথাও না। এখন রাত বাজে সাড়ে এগারোটার ওপরে। বনবাদাড়ে সাড়ে এগারোটা মানে হচ্ছে গভীর রাত। আধ ঘণ্টার মতো গাছে কাটিয়ে দিলাম, কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখনো। তার পরেও হাল ছাড়েনি। ওয়াকিটকির আওয়াজে কারো না কারো তো ঘুম ভাঙ্গবে নিশ্চয়ই। চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম বারবার। এরিমধ্যে টের পেলেন সহকারী ম্যানেজার বিনয় ভৌমিক। ঘুম চোখে নিয়েই কথা বলছেন তিনি, তাই স্পষ্ট বুঝতে পারছেন না কী বলছি। বারবার বলতে লাগলাম, ‘বিপদে পড়েছি, উদ্ধার করুন।’
 
বিপদ কথাটা কানে যেতেই বিনয় ভৌমিকের হুশ হলো। তিনি এবার মনোযোগ সহকারে সব কিছু শুনলেন। শুনে তিনি শোয়া থেকে লাফিয়ে ওঠলেন এবং দ্রুত কয়েকজনকে ঘুম থেকে জাগালেন। তার পর সবাই মিলে পরামর্শ করতে লাগলেন আমাদেরকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়। একেকজন একেক রকমের পরামর্শ দিলেন ওয়াকিটকির মাধ্যমে। পরিশেষে তারা মশাল জ্বালিয়ে কয়েকজন মিলে বন্দুক নিয়ে আসার উদ্যোগ নিলেন। আমি বললাম, তার আর দরকার নেই, কুকুরগুলো চলে গেছে। এখন হাতিটা পাঠালেই আমরা নিরাপদে পৌঁছতে পারব। আমার সিদ্ধান্ত তাদের মনে ধরেছে, সঙ্গে সঙ্গে তারা মাহুতকে জাগিয়ে হাতি নিয়ে দুইজন সশস্র প্রহরীসহ চলে এলেন আমাদেরকে উদ্ধার করতে। 


বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

সর্বশেষ খবর