মেঘলা অফিসের নিকটতম মৌজা সাগরমুখী। প্ল্যান্টের প্রধান অফিস থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। যাতায়াত করতে হয় পায়ে হেঁটেই। শ্বাসমূলের কারণে সাগরমুখীর জঙ্গলে হেঁটে যাওয়ার অন্য কোনো উপায় নেই। ধীরে সুস্থে দেখেশুনে পা ফেলতে হয়, না হলে পায়ে খোঁচা লেগে ক্ষতবিক্ষত হতে পারে। অপরদিকে হাতির পিঠে চড়ে সাগরমুখী যাতায়াত করা মোটেই সম্ভব নয়, এক পা ফেলারও সুযোগ নেই হাতির। শ্বাসমূল না থাকলে ঘণ্টা দুয়েক বা আরও কম সময়ের মধ্যেই পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব হতো আমাদের।
সাগরমুখীতে আমাদের শাখা অফিস কিংবা বাংলো কোনটাই নেই। কিছুটা কাছাকাছি বিধায় কাজকর্ম সেরে দিনের শেষেই চলে আসতে পারি। আর খুব বেশি প্রয়োজন হলে গাছে মাচাবেঁধে রাতযাপন করি। এই জঙ্গলে তাঁবু খাটানোরও সুযোগ নেই। জোয়ার-ভাটা অধ্যুষিত এলাকা বিধায় সবসময় মাটি থাকে স্যাঁতসেঁতে; পোকামাকড়েরও কমতি নেই। সাগরমুখী মৌজার অধিকাংশ গাছগুলো ম্যানগ্রোভ অরণ্যের গাছ। ওখানে বেশিরভাগই কেওড়া, গেওড়া, গরান, বাইন এসব গাছের সমাহার। ভেষজ গাছগুলো অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় লাগানো হয়েছে। আবার আমরা নিজেরাও মাটি ফেলে উঁচু ঢিবি বানিয়ে গাছপালা লাগিয়েছি। দু’টি কারণে উঁচু ঢিবি বানিয়েছি, প্রথমত: জোয়ারে যেন ভেষজ গাছের সমস্যা না হয়। দ্বিতীয়ত: হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীগুলো যাতে জোয়ারে নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে ঢিবিতে ওঠে। কিন্তু তার পরেও হরিণের জন্য সাগরমুখী নিরাপদ নয়। অতিরিক্ত বর্ষণে কিংবা ভরা কাটালের জোয়ারে হরিণগুলোর খুব সমস্যা হয়। জোয়ারের জলে হরিণগুলোকে দূরে ভাসিয়ে নিয়ে গেলে দুষ্কৃতিকারিদের হাত থেকে আর রক্ষা পায় না ওরা।
সাগরমুখী জঙ্গলের অবস্থান সমুদ্র সৈকত থেকে খানিকটা দূরে। তবে পূর্বদিকে সমুদ্র কাছাকাছি হলেও ওখান দিয়ে যাতায়াত করা মোটেও সম্ভব নয়। বরং মেঘলা মৌজা সমুদ্র সৈকতের সন্নিকটে, ফলে মন চাইলে পূর্ণিমারাতেও সৈকতে বিচরণ করতে পারি।
বৈশাখের দ্বিতীয় সপ্তাহ। আমরা চারজন সাগরমুখী রওয়ানা দিয়েছি গোলপাতা কাটার তদারকি করতে। এ জঙ্গলের খাল পারে প্রচুর গোলগাছ জন্মে। মৌসুমে কোম্পানির বেশ টাকা উপার্জন হয় গোলপাতার মাধ্যমে। আমরা অবশ্য নিজেরা পাতা কাটি না, নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করি। চৈত্র-বৈশাখ মাসে দুই-একদিন সাগরমুখীতে আমাদের ব্যস্ত সময় কাটে তাই। সুন্দরবনের মতো এদিকে পেশাদার বাওয়ালি না থাকায় এখানকার গোলপাতাগুলো এলাকার বেপারীরা কিনে নেয়। তারা নিলামের মাধ্যমে কিনে লোকালয়ে বিক্রি করে বেশ টাকা উপার্জন করে, আমাদের কোম্পানিও লাভবান হয় তাতে। ফলে বছরের কয়েকটা দিন এখানে আমাদের সময় দিতে হয়, না হলে বেপারীর লোকেরা অনেক তছরুপ করে। নিয়মের চেয়েও বেশি পরিমাণে গোলপাতা কেটে নিয়ে যায়। অবাধে অন্যান্য গাছপালাও কেটে ফেলে, আবার সুযোগে হরিণ শিকারও করে। কাছাকাছি না থাকলে সামলানো দায়। হেড অফিসের নির্দেশে তাই গোলের মৌসুমে সাগরমুখীতে অবস্থান করতে হয়।
সেদিন সকাল ১০টা নাগাদ মহব্বত দয়াল ও দুইজন শ্রমিকসহ সাগরমুখী যাত্রা করলাম। প্ল্যান্টের শ্রমিকদের ওখানে তেমন প্রয়োজন নেই। বেপারীদের লোকজনই গোলপাতা কেটে নৌকা বোঝাই করে নিয়ে যায়। আমরা শুধু দেখভাল করি, আর ব্যাংকে টাকা-পয়সা জমা হয়েছে কীনা তা নিশ্চিত করি। আমাদের এখানে নগদ টাকার কোন কারবার নেই। কাজেই কাগজপত্র সঠিক কীনা সেটাই নিশ্চিত করতে হয় সবার আগে।
তারপরেও দুই-একজন শ্রমিককে সঙ্গে নিতে হয়, মাচা বাঁধতে অথবা রান্নাবান্নার কাজে মহব্বত দয়ালকে সহযোগিতা করার জন্যে।
বৈশাখের খরতাপে দগ্ধ হয়ে আমরা বনের ভেতরের সরুপথ ধরে রওয়ানা দিয়েছি সাগরমুখীর উদ্দেশ্যে। বনপ্রান্তরে রোদের ঝিলিক না থাকলেও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হচ্ছে। ঠাঁসা গাছপালা, বাতাস বইতে পারছে না, ফলে ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হয়ে এল সমস্ত শরীর। তার ওপরে হাঁটতেও বেগপেতে হচ্ছে, সতর্কতার সঙ্গে হাঁটতে হচ্ছে তাই। সামান্য এদিক-সেদিক হলে শ্বাসমূলের ওপর পা পড়তে পারে, সেটিও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। না হলে পা কেটে যাওয়াও অসম্ভবের কিছু নয়।
শ্রমিকদের হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে; মাথায় বোঝা, রান্নাবান্নার তৈজষপত্র, খাবারজল, বিছানাপত্র ইত্যাদি নিয়ে হাঁটা চাট্টিখানি কথা নয়। অপরদিকে মহব্বত দয়ালের কাঁধে দোনালা বন্দুক, হাতে অন্যান্য সামগ্রী। আমার হাতে লাঠি, আর ছোট্ট একটা ব্যাগ। তাতেই আমি হাঁটতে হাঁপিয়ে উঠছি বারবার। আর শ্রমিকরা যে কী কষ্ট পাচ্ছে, তা না বুঝার কিছু নেই আমার। এত কষ্টের পরেও শ্রমিকরা সাগরমুখী আসতে উৎফুল্লবোধ করছে। তার কারণও আছে অবশ্য। সেটি হচ্ছে দৈনিক হাজিরা ছাড়াও আমি ওদেরকে ব্যক্তিগতভাবে কিছু অর্থকড়ি প্রদান করি সাগরমুখী এলে।
আগেই বলেছি, প্ল্যান্ট থেকে প্রাপ্ত বেতনাদি আমি কখনো একাভোগ করিনি। খাবারদাবারের ব্যবস্থা কোম্পানি থেকে হওয়ায় সেটি ভোগ করছি সত্যি, তবে বেতনাদির বেশির ভাগই প্ল্যান্টের স্টাফদের মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছি, কারণ আমার এসব ভোগ করার কেউ নেই জগতে। পূর্বেকার সরকারি চাকরি থেকে পেনশন বাবদ যে অর্থকড়ি পাচ্ছি তা মেয়ের নামে ডিপোজিট করে রেখেছি। যদি মেয়ে কখনো এদেশে আসে, তবে সে এই টাকার মালিক হবে। নচেৎ ...।
ধীরগতিতে হাঁটছি আমরা। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি সবাই। অতিরিক্ত গরম না হলে এতটা ক্লান্ত হতাম না হয়তবা। একটু যে বসে কোথাও জিরিয়ে নিব তারও উপায় নেই। স্যাঁতসেঁতে মাটি, বসার জো নেই কোথাও। পরিস্রান্ত হয়ে মহব্বত দয়ালকে বললাম, ‘আর পারছি না, একটু বসার ব্যবস্থা কর।’
সে বলল, ‘বড়মিয়া আর পাঁচমিনিট হাঁটলেই শুকনা জায়গা পেয়ে যাব, সেখানেই জলখাবার খাবেন।’
‘ঠিক আছে, হাঁট তাহলে।’
হাঁটতে হাঁটতে অল্প সময়ের মধ্যেই অপেক্ষাকৃত শুষ্ক জায়গার সন্ধান পেলাম। সেই জায়গা খানিকটা উঁচু, ছায়া শীতলও। উঁচু উঁচু গাছপালা, খালিশা গাছ প্রচুর, আর হরেক লতাগুল্মে ঠাঁসা। ফাঁকা জঙ্গল বিধায় সামান্য বাতাসও বইছে টের পেলাম। শরীর মন জুড়ানোর জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন জায়গা বনপ্রান্তরে এ মুহূর্ত আর খুঁজে পেলাম না। এটি প্রকৃতির আশীর্বাদ মনে হলো আমার কাছে। ছায়া সুনিবিড় সুশীতল শুষ্ক এমন জায়গা সাগরমুখীর জঙ্গলে খুব একটা মিলে না। জোয়ার-ভাটার কারণে সমস্ত জঙ্গলই স্যাঁতসেঁতে, ফলে এখনকার জীববৈচিত্র্য যেমন ভিন্নতর, তেমনি চলাফেরা কিংবা বাসেরও অনুপযোগী।
সাগরমুখীতে খেপাটে মহিষ নেই, শেয়াল কুকুরের উপদ্রব মাস দুয়েক আগেও ছিল, বিষ প্রয়োগের পর কিছুটা নিরাপদ। তবে এখানে প্রচুর বিষধর সাপ কিলবিল করছে। খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হচ্ছে তাই। সতর্ক হলে বিপদ এড়ানো সম্ভব, না হলে মৃত্যু অবধারিত। সেরকম রোমাঞ্চকর একটি ঘটনাই জানাচ্ছি এখন।
আমরা জিরিয়ে নিতে বসলাম খালিশা তলায়। খালিশা ভেষজগুণ সমৃদ্ধ একটি গাছ। এ গাছের ফুলের মধু সব সময়ই চড়া দামে বিক্রি হয়। সুন্দরবনে মৌয়ালদের কাছে তাই এই ফুলের মধুর কদর সবচেয়ে বেশি। দ্বীপ বনে মৌয়ালের সংখ্যা একেবারেই কম, ফলে এখানকার মধু আহরণও কম হয়। গাছের মধুচাক গাছেই থেকে যায় অনেক সময়, কেউ ভাঙে না। খুব বেশি মধু অবশ্য দ্বীপ বনে পাওয়াও যায় না। একেবারেই সামান্য, ফলে মৌয়ালদের যাতায়াত এখানে তেমন একটা নেই।
এ সময় খালিশা গাছে প্রচুর ফুল আসে। খালিশার ফুটন্ত ফুল দেখতে ভারি চমৎকার; ধবধবে সাদা, আকারে ছোট। ফোটার আগে ফুলগুলো তত আকর্ষণীয় দেখায় না; গুচ্ছফুল, মাথা সুঁচের মতো। আমরা যেখানে বসে আছি, ঠিক ওই বরাবর মাথার ওপরে অসংখ্য মৌমাছির আনাগোনা লক্ষ্য করলাম; মধু আহরণে ব্যস্ত ওরা। গুনগুন সুরে গান গাচ্ছে, আর ফুলের পাপড়ির ওপরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ওদের ব্যস্ত যাতায়াতে বারবার ফুলের গায়ে স্পর্শ লাগায় অসংখ্য পাপড়ি আমাদের মাথার ওপরে ঝরে পড়ছে। তাতে মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি ফুল ছিটিয়ে আমাদের সাদর সম্ভাষণ যানাচ্ছে। এই কাঠফাটা গরমের এমনি এক মুহূর্তে কী যে ভালো লাগছিল তা ভাষায় ব্যক্ত করতে পারছি না আমি। পুষ্পস্নানে সিক্ত হতেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই ক্লান্তি দূর হয়ে গেল আমার। এরিমধ্যে মহব্বত দয়াল জলখাবার খেতে দিলো। পরিতৃপ্তির সঙ্গে খেয়েদেয়ে কিছুক্ষণ বসতেই আমার ঝিমুনি এসে গেল, চোখ বুজে আসছে ঘুমে। সেই মুহূর্তে আবার মহব্বত দয়াল ফ্ল্যাস্ক খুলে চা পরিবেশন করল। লেবু মিশ্রিত গরম আদা চা থেকে ভুরভুর করে ধুয়া উঠছে তখনো, চায়ের সেই মনমাতানো গন্ধে আমার ঘুম উধাও হয়ে গেল।
চা পর্বও শেষ, আর দেরি নয়, অতিক্রম করতে হবে আরও দেড় ঘণ্টার পথ। গন্তব্যে গিয়ে দুই রাত কাটাতে হবে। সুতরাং গিয়েই আগে মাচা বাঁধতে হবে, তাছাড়া রান্নাবান্নার কাজ তো আছেই। শরীরের ক্লান্তি দূর হতেই হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। পরিশেষে আর বিরতি না দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সাগরমুখী পৌঁছলাম।
সাগরমুখী পৌঁছেই বেপারীদের সাক্ষাৎ পেলাম, তারা আগেভাগেই এসেছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে এখন। আমাদের দেরি দেখে তারা বসে থাকেনি, বুদ্ধি করে তাদের শ্রমিকদেরকে দিয়ে দুই গাছে দু’টি মাচা বেঁধে রেখেছে। কারণ তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতায় জানা আছে, সাগরমুখী এলে আমাদেরকে মাচায় রাতযাপন করতে হয়।
বেপারীদের কাগজপত্র পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে ওদেরকে গোলপাতা কাটার অনুমতি দিলাম। পাশাপাশি সতর্ক করলাম কোন ধরনের তছরুপ যেন না করে। যদি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় ফি বছর গোলবনে তারা নিষিদ্ধ হবে, সেই নোটিশও দিয়ে রাখলাম। আবার চিতা হরিণের ব্যাপারেও কঠোর হঁশিয়ারি দিলাম, ভুলেও যেন বিরক্ত না করে, শিকার তো দূরের কথা।
ওদেরকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দিতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। এই মুহূর্তে কাজ একটাই রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকা, আপাতত অন্য কোন কাজ নেইও আর। এখন সমস্যা হচ্ছে গোসলাদি নিয়ে, কারণ তখনো খালে জোয়ারের জল ঢুকেনি। আর কিছুক্ষণেই মধ্যেই জোয়ার আসবে, তখন গোসলের সুযোগ হবে। কিন্তু ততক্ষণে অস্থির লাগছে, ঘেমে নেয়েঅস্থির হওয়ায় গোসলাদি সারতে পারলেই যেন বাঁচি।
ইতোমধ্যে মহব্বত দয়াল শুকনো উঁচু জায়গায় কেরোসিনের চুলা বসিয়ে আগুন জ্বালাল। আমাদের চারজনের রান্না, কেরোসিনের চুলাই যথেষ্ট। বনের মধ্যে মাটিখুঁড়ে চুলা বানানো যায় ঠিকই, কিন্তু মাটি স্যাঁতসেঁতে থাকায় আগুন জ্বলতে চায় না, তাই আমরা সঙ্গে করে কেরোসিনের চুলা নিয়ে আসি সবসময়।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যেই রান্নাবান্না হয়ে গেল, সেই সুযোগে আমি গোসলাদি সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। এরইমধ্যে বনে জোয়ারের জল ঢুকতে শুরু করছে, ধীরে ধীরে জল বাড়ছেও। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাঁটু সমান জলে নিমজ্জিত হয়ে যাবে সাগরমুখীর জঙ্গল। তখন স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হবে আমাদের। বিশেষ করে খাবার-দাবার মাচার ওপরে বসেই খেতে হবে, বিকল্প আর কোন সুযোগ নেই এই মুহূর্তে।
বেপারীর লোকজনেরা আমাদের জন্য দু’টি মাচা বেঁধে রেখেছে আগেই, তাতে আমাদের কাজের চাপও কমেছে। পাশাপাশি তে-ডালার শক্তপোক্ত গাছ না পাওয়ায় মাচা দু’টি সামান্য দূরত্বের ভিন্ন গাছে বেঁধেছে ওরা। তবে খুব বেশি দূরে নয়, কাশির আওয়াজ শুনা যায় অমন দূরত্বে মাচার দু’টির ব্যবধান। আর বেপারীর লোকেরা তাদের নৌকায়ই রাতযাপন করবে। গাদাগাদি করে কোনো রকম শুয়ে বসে রাত পার করবে তারা; সেই চিন্তা অবশ্য আমাদের নেই।
মাধ্যাহ্নের খাবার খেলাম মাচার ওপর বসেই। খাবার মেনুতে ছিল মুসুরির ডাল ভুনা, ডিম আর আলুভর্তা। পেটে প্রচণ্ড ক্ষিধা থাকায় পেট ভরে ভাত খেলাম; চেটেপুটেই খেলাম। রাতের খাবার রান্না হবে জোয়ার নেমে গেলেই, সেই চিন্তা মহব্বত দয়ালের। আমার এখন একটু বিশ্রাম চাই, অনেক পরিশ্রান্ত।
মহব্বত দয়াল মাচার ওপরে কাঁথা বিছিয়ে বিছানা পেতে দিল। ও আর আমি একই মাচায় রাত কাটাব, এ রকমই সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের। মহব্বত দয়াল আমার মাচায় থাকতে আপত্তি জানিয়েছে প্রথম, আদবের খেলাপ হয় এই জন্যে। তার ইচ্ছে তারা তিনজন এক মাচায় থাকবে। বিষয়টা বেখাপ্পা লাগছে; গাদাগাদিও হবে, তাই ওকে বললাম, ‘সংকোচ করো না। তুমি-আমি এক সঙ্গেই থাকব। তাছাড়া আমি একা একা থাকতে পারব না। কাজেই তুমি আমার মাচায় থাকবে।’
আমি সিদ্ধান্তটা দিয়েই মাচায় শোয়ে পড়লাম। মহব্বত দয়াল আর শোয়নি। দিবানিন্দ্রা তার সয় না, শোয়া থেকে ওঠলে মাথাব্যথা করে না কি। যার জন্য সে তার দোনালা পয়পরিষ্কার করতে লাগল।
মাচায় শওয়ে আমি এদিক-সেদিক কাত হচ্ছিলাম, ঘুম আসছে না; আবার চোখও বুজে আসছে; অমন করতে করতে ১৫-২০ মিনিট পর চোখের পাতা লেগে এল। অমনি মহব্বত দয়াল আমাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সজাগ করে দিলো। বিষয়টা কি হতে পারে? মহব্বত দয়াল কখনো আমার গায়ে হাত লাগিয়ে কথা বলেনি, ধাক্কা দেওয়া তো দূরের কথা।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মহব্বত দয়াল আবার সেই কাজটি করল। আমি ধড়ফড় করে ওঠে বসলাম। এমতাবস্থায় ওর মুখে কথা নেই, ইশারায় মাথার ওপরে গাছের ডালে আঙ্গুল তাক করে কী যেন দেখাল। ওর আঙ্গুলের নিশানা বরাবর আমি তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড় হয়ে গেল। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। আমাদের মাথার কয়েক ফুট ওপরে একটা সাপ গাছের ডাল প্যাঁচিয়ে আছে। সাপটার জিভ লকলক করছে। তাই দেখেই আমার শরীর হিম হয়ে এল। কী করার আছে এখন বুঝতেও পারছি না। আমাকে হতবুদ্ধি হতে দেখে মহব্বত দয়াল বলল, ‘বড়মিয়া, দ্রুত নিচে নামেন।’
এমতাবস্থায় আমার হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে, হুঁশ নেই আমার। মহব্বত দয়াল আমাকে পূনরায় তাড়া দিলো নিচে নামতে। আমি কাঁপতে কাঁপতে নিচে নামলাম; আমার পেছন দিয়ে নামল মহব্বত দয়ালও।
নিচে নেমে মহব্বত দয়াল শ্রমিকদেরকে কাছে ডেকে বৃত্তান্ত জানাল, দেখাল সাপের অবস্থানও। সাপের অবস্থান দেখে ওরাও বিস্মিত হলো। এতটাই কাছাকাছি ছিল সাপটা আমাদের। তার পর ওরা বুদ্ধিকরে দ্রুত বড় একটা লাঠির মাথায় কাঁচি বেঁধে হেঁচকা টানে সাপটাকে নিচে ফেলল। সাপটা ততক্ষণে দ্বিখণ্ডিত প্রায়, আর পিটিয়ে মারতে হয়নি ওটাকে, নিজ থেকে দুই-চার মোচড় দিয়েই শেষ হয়ে গেল।
গাছের ডালে সাপটা দেখার পর থেকেই ভয়ভীতি আরও বেড়ে গেল আমার। কেবল মনে হচ্ছে আরও সাপ মাচার আশপাশে কিলবিল করছে। চোখের ওপর ভাসছে জিভ লকলক করা অগনতি সাপের চিত্র। সেই চিত্র দর্শনে রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না, উদ্বিগ্ন অবস্থায় পালা করে সজাগ থেকে দু’রাত কাটালাম।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা