শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

দিল্লিতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া

সাইফ ইমন

দিল্লিতে নিজামউদ্দিন আউলিয়া

ভারতীয় উপমহাদেশে যে কজন সাধক এসে সুফি মতবাদ জনপ্রিয় করেছেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া তাদের মধ্যে একজন। চিশতিয়া তরিকার সুফি সাধক ছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদরা বলেন, তৎকালীন দিল্লিবাসীর ওপর ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রবল প্রভাব বিস্তার করেন এবং পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া বলতেন, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ আর তাই মানুষকে ভালোবাসলেই আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন। এই মহান সুফি সাধককে নিয়ে আজকের রকমারি-

 

পাক-ভারত উপমহাদেশে যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তাদের অন্যতম...

শেখ খাজা সৈয়দ মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন আউলিয়া হলেন ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক। তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়া নামেই বহুল জনপ্রিয়। ভারতে চিশতিয়া তরিকার অন্যতম মহান সুফি সাধকদের মধ্যে তিনি একজন। তার গুরু ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার। যার মূল কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি হয়ে খাজা মঈনউদ্দিন চিশতির সঙ্গে মিলিত হয়। এই অনুযায়ী তারা চিশতিয়া তরিকার মৌলিক আধ্যাত্মিক ধারাবাহিকতা বা সিলসিলা তৈরি করেছেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ভারতের উত্তরপ্রদেশের বাদায়ুনে ১২৩৮ সালের ৩ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৩২৫ সালে ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। পাঁচ বছর বয়সে তিনি দিল্লি আসেন। অনেকেই দাবি করেন মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি হজরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের নাম স্মরণ করতে থাকেন। ২০ বছর বয়সে পাকিস্তানের পাকপাত্তান চলে যান এবং সুফি ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের বাইয়াত গ্রহণ করেন। তিনবার রমজান মাসে বাবা ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের দরবারে অবস্থান করেন। এখান থেকেই তিনি সুফিবাদের দীক্ষা গ্রহণ করেন। চিশতিয়া তরিকার একজন সাধক হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেন। হজরত ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকারের প্রিয় শিষ্য হয়ে উঠেন ধীরে ধীরে। পরবর্তীতে তার মুর্শিদ বাবা ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার তাকে খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন। এরপর থেকে তিনি চিশতিয়া তরিকার মশাল সামনে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। এর কয়েকদিন পর হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া দিল্লিতে ফিরে আসেন। এরপর তার মুর্শিদ ফরিদউদ্দিনের ওফাতের খবর জানতে পারেন তিনি। উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার একজন প্রখ্যাত সুফি সাধক ছিলেন তিনি।

পাক-ভারত উপমহাদেশে যাদের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম প্রচারিত হয়েছে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। হজরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি, হজরত বাবা হাজী আলী, হজরত মাওলানা ফজলুর রহমান গঞ্জে মোরাদাবাদী মোহাজের মাক্কিসহ অসংখ্য ওলি-আউলিয়ার পদচারণায় পথহারা কোটি কোটি মানুষ দীনের সন্ধান লাভ করেছিলেন।

নিজামউদ্দিন আউলিয়া তার মুর্শিদের কথা বলতে গিয়ে শিষ্যদের বলেন, বাবা ফরিদের নাম শুনার পর তার মনে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল অন্য কোনো সুফি সাধকের নাম শুনে এমনকি তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরও তার এ অবস্থা হয়নি। আগুনের ফুলকির মতো তার প্রেম বাড়তেই থাকে।

যদি তার সহপাঠীরা তাকে দিয়ে কোনো কাজ করাতে চেষ্টা করতেন তখন তারা বাবা ফরিদের নামে দোহাই দিতেন এবং তিনি কখনো কেউ বাবা ফরিদের নামে দোহাই দিলে সে কাজে মানা করতেন না। যত কষ্টই হোক তিনি তা পূরণ করতেন। তিনি তার জীবনে কারও জন্য এ ধরনের অনুভূতি অনুভব করেননি। হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া তার পূর্বসূরিদের মতো প্রেম বা স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসার পথ অনুসারীদের বর্ণনা করেছেন। তার মতে স্রষ্টার প্রতি ভালোবাসা মানবতার প্রতি ভালোবাসার জন্ম দেয়। তৎকালীন দিল্লিবাসীর ওপর ব্যক্তিত্বের জাদু নিয়ে নিজামউদ্দিন আউলিয়া প্রবল প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হন এবং পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া বলতেন, আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষ আর তাই মানুষকে ভালোবাসলেই আল্লাহ সবচেয়ে বেশি খুশি হন। জিয়াউদ্দিন বারানি নামের চৌদ্দ শতকের একজন ঐতিহাসিক দাবি করেন যে, দিল্লির মুসলমানদের ওপর তার প্রভাব এমন ছিল যে, পার্থিব বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়। মানুষ আধ্যাত্মিক ইবাদতের প্রতি মনোযোগী এবং দুনিয়াবী চিন্তা থেকে পৃথক হয়ে পড়ে। কথিত আছে যে, হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার আধ্যাত্মিক এলেম ছিল অনেক উঁচুস্তরের। উপমহাদেশের লাখো লাখো মানুষকে হেদায়েত করে  গেছেন তিনি। উপমহাদেশের লাখো লাখো মানুষ হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজারে গমন করে থাকেন। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিজামউদ্দিনের দরগাহে প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার মুসলিমসহ হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা পরিদর্শনে আসেন। প্রতি বছর আরবি ১৭ রবিউস সানি হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার ওফাতবার্ষিকী দিল্লিতে তার মাজার শরিফে পালিত হয়।

 

শিষ্য

নিজামউদ্দিন আউলিয়ার প্রায় ৬০০-এর বেশি শিষ্য ছিলেন। শিষ্য সবাই হতে পারেন না। একজন শিষ্যকে শিষ্য হতে হলে যোগ্য হতে হয়। বায়াত গ্রহণ করার অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে শিষ্যত্ব দেওয়া হায়। যাদের হাত ধরে গুরুর হাতে অর্পিত মশাল সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যারা বিশ্বময় গুরুর আধ্যাত্মিক সাজরাকে বজায় রেখে চলেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কয়েকজন বিখ্যাত শিষ্য হলেন নাসিরউদ্দিন চিরাগ দেহলভি, আমির খসরু, আঁখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ, বোরহানউদ্দিন গরীব, জালালউদ্দিন ভান্ডারী, সৈয়দ মাহমুদ কাশকিনাকার, আজান ফকির প্রমুখ। সবার মধ্যে আমির খসরু ছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সবচেয়ে প্রিয় শিষ্য। তিনি তার এতটাই প্রিয় ছিলেন যে, একদিন নিজামউদ্দিন আউলিয়া বলেন, ‘যদি শরিয়ত আমাকে অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সঙ্গে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।’ তিনি আরও বলেন, কেউ যদি আমার রওজা (সমাধিস্থল) জিয়ারত করতে আসে, তাহলে সে যেন প্রথমে আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে পরে তার রওজা জিয়ারত করে। নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পরলোকগমনের কয়েক মাস পর আমির খসরুও পরলোকগমন করেন। তাকে তার পীরের পায়ের কাছে সমাধিস্থ করা হয়। মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ ছিলেন আমির খসরু। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গায়ক, সুফি, দার্শনিক ও যোদ্ধা। প্রধানত ফার্সি ও হিন্দি ভাষায় তিনি গান ও কবিতা লিখতেন। অসাধারণ গান ও কবিতার মাধ্যমে তিনি ভক্তদের কাছ থেকে উপাধি পেয়েছিলেন ‘তুত-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা পাখি’ হিসেবে। আমির খসরু একই সঙ্গে তুর্কি, ইরানি এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন।

 

খুন করার ঘটনার কোনো সত্যতা নেই
ছোটবেলায় মা-খালাদের মুখে ইসলামের গুণগান সংবলিত গল্পসমূহে যে নিজাম ডাকাতের উপস্থিতি ছিল সেখানে তিনি ৯৯ জন লোক খুন করার পর আউলিয়া হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। সেটা আদতে অন্যান্য কল্পকাহিনীর মতো বানানো; রূপকথা। স্থানীয়দের দাবি এমনটাই। নিজামউদ্দিন আউলিয়া উঠতি বয়সেই সুফি মতবাদ লাভ করেছিলেন এবং তা চর্চা করে আধ্যাত্মিকতা লাভ করেছিলেন। তিনি আদতে কোনো খুন করেননি। নিজামউদ্দিন আউলিয়া বংশগত দিক থেকে ছিলেন হজরত আলী (রা.)-এর উত্তরসূরি। তার মৃত্যুর পর ফিরোজ শাহ তুঘলক কবরে সমাধিসৌধ নির্মাণ করলেও পরে তা অবলুপ্ত হয়। এরপর ১৫৬২-৬৩ সালে ফরিদ খান নামে এক ধনী আর একটি সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন যা বর্তমানের দরগাহ শরিফের অনুরূপ বলে মানেন স্থানীয়রা। তারা আরও বিশ্বাস করেন হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া আধ্যাত্মিক এলেমে এতই উঁচুস্তরের ছিলেন যে, ভালো যে কোনো নিয়তে তার দরবারে গেলে এই ওলি-আউলিয়ার ওছিলায় মহান আল্লাহতাআলা তার মনোবাসনা পূর্ণ করে দেন। খাজা-ই-হিন্দ হজরত খাজা মঈনউদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের পূর্বে দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার শরিফ জিয়ারত করার একটা নিয়মও প্রচলিত আছে।

 

জালালি কবুতর

বাংলাদেশের সিলেটের হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারে আমরা যে জালালি কবুতর দেখতে পাই তা দিয়েছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। অনেক ইতিহাস লেখকের বইয়ে এ বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে। হজরত শাহজালাল (রহ.) ভারতবর্ষ সফরকালে দিল্লিতে এসেছিলেন। এভাবে পূর্বদিকে চলতে চলতে একসময় দিল্লি এসে পৌঁছলেন। দিল্লিতে  পৌঁছার পর হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া জানতে পারলেন তার এলাকায় একজন দরবেশ সুদূর ইয়েমেন হতে এসেছেন। যার সঙ্গে অনেক শিষ্যও রয়েছেন। এরপর নিজামউদ্দিন আউলিয়া তার এক শিষ্যকে পাঠালেন হজরত শাহজালালের (রহ.) কাছে তার দরবারে আমন্ত্রণ জানিয়ে। পরবর্তীতে হজরত শাহজালালের (রহ.) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নিজামউদ্দিন আউলিয়ার। পরে দিল্লিতে হজরত শাহজালাল (রহ.) যতদিন ছিলেন ততদিন হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার (রহ.) দরবারে শিষ্যদের নিয়ে অবস্থান করেন। দিল্লি থেকে সিলেটের দিকে আসার সময় হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া হজরত শাহজালাল (রহ.)কে একজোড়া কবুতর উপহার দেন। সেই কবুতরই ‘জালালি কবুতর’ নামে পরিচিতি পায় সর্বত্র। এই জালালি কবুতরই সিলেট ও বিভিন্ন জেলায় সর্বত্র মনের সুখে ঘুরে বেড়ায় এবং দরগাহ প্রাঙ্গণে কবুতরগুলোকে পুণ্যার্থীরা খুব আদরযতœ করে খাদ্য প্রদান করে থাকে। আদতে এই কবুতর জোড়া এসেছিল দিল্লি থেকেই।

 

শৈশব থেকেই মেধাবী

ছোট বয়সেই হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পিতা খাজা আহমদ ইন্তেকাল করেন। তিনি মৃত্যুকালে কোনো সম্পদ রেখে যাননি। নিজাম ও তার মাকে অত্যন্ত অভাব ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করতে হয়। অধিকাংশ সময় অভুক্ত থাকার মতো পরিস্থিত দেখা দিত। কিন্তু তার মা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং আল্লাহভক্ত। যেদিন ঘরে কোনো খাদ্য থাকত না নিজামের মা মুচকি হেসে বলতেন, ‘নিজাম আজ আমরা আল্লাহর মেহমান।’ এ কথা শিশু নিজামের খুব পছন্দ হতো। আল্লাহর মেহমান হওয়া নিশ্চয়ই দারুণ ব্যাপার। আবার কখনো কখনো যখন খাবার থাকত বেশ কিছুদিন, তখন শিশু হজরত নিজামউদ্দিন অজ্ঞাতসারে বলতেনÑ ‘মা! এখন  তো অনেক সময় অতিবাহিত হয়ে  গেল, আমরা কখন আল্লাহর মেহমান হব?’

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লেখক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এই মায়ের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতায় নিজামের লালন-পালন হয়েছেন। তার মা অধিকাংশ সময় তাকে ওলি-দরবেশদের   কেচ্ছাকাহিনি শুনাতেন। তিনি মোজাহেদ ও সাধকদের কাহিনি আকর্ষণীয়ভাবে বর্ণনা করতেন। নিজামের কাছে এসব কাহিনি এবাদত মনে হতো। তখন  থেকেই তিনি চাইতেন, যদি কোথাও থেকে কোনো গায়েবি ব্যক্তি এসে এমন এক ভুবনে পৌঁছে দিত, যেখানে তার আল্লাহ ব্যতীত কেউ থাকবে না। নিজামউদ্দিনের মা ছেলের  নিষ্পাপ বাসনা শুনে হাসতেন এবং তাকে সান্ত্বনা দিতেন। বলতেন, বেটা, আল্লাহ তোমাকে উচ্চ মর্যাদা দান করুন। তবে এ জন্য তোমাকে তোমার পিতা ও নানার অনুসরণ করতে হবে। জ্ঞান অর্জন করে প্রিয় নবীর চরিত্রে চরিত্রবান হতে হবে। নিজাম তার মার উপদেশ বাণী গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনতেন। দিনে পর দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় রোজা রাখতেন। লোকেরা বলত, নিজাম এখনো তোমার ওপর রোজা ফরজ হয়নি। নিজাম বলতেন, খাবারের চেয়ে  রোজাই আমার কাজে মজাদার,  রোজাই আমার প্রিয় খাদ্য। তার মা কোরআন শিক্ষার জন্য তাকে মক্তবে পাঠিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি অসাধারণ মেধা ও ধীশক্তির অধিকারী ছিলেন, তাই অল্প দিনের মধ্যে কোরআন পাঠ খতম করেন ও আরবির প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে থাকেন এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা শেষ করেন। তিনি ফিকার কিতাব কুদুরি বদায়ুনের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আলাউদ্দিন উসুলির কাছে কোরআন খতম করেন। উপমহাদেশে যাদের ত্যাগ, শ্রম ও আধ্যাত্মিকতার বিনিময়ে কোটি কোটি মানুষ দীনের সন্ধান লাভ করেন তন্মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন অন্যতম। জীবদ্দশায় কঠোর আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে পথভ্রষ্ট লাখো মানুষকে হেদায়েত করে গেছেন। আর তাই বিশ্বে তরিকতের অনুসারীদের কাছে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া একটি সুপরিচিত নাম। ভারতের দিল্লি যারা সফর করে থাকেন, তারা এই মহান আউলিয়ার মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে ছুটে যান।

 

সম্রাটের কাঠগড়ায়

ইতিহাসে নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে নিয়ে অনেক ঘটনার একটি হলো তৎকালীন সম্রাটের দরবারে। দিল্লির সিংহাসনে তখন গিয়াসউদ্দিন বলবন (১২৬৫-১২৮৭)। এই বলবন ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। যার নাম শুনলে প্রজাদের ঘুম হারাম হয়ে যেত। এই সম্রাটের দরবারে নালিশ যাওয়া মানেই ভীতিকর কিছু। প্রজারা প্রচন্ড ভয় পেত এই শাসককে। বলবনের দরবারে আসামি হয়েছিলেন নিজামউদ্দিন। অভিযোগ মুসলমান ও বিধর্মীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেন না তিনি, শরিয়তের আইন না মেনে খামখেয়ালি করছেন নিজামউদ্দিন। নিজামউদ্দিন সব অভিযোগই খন্ডন করলেন। বললেন, হে সুলতান, এ কথা সত্য যে, আমি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান কারও মধ্যে ভেদাভেদ করি না। কারণ আল্লাহর জমিনে সবাই তার বান্দা, আদম সন্তান।

এ কথার পর কেউ কেউ অভিযোগ করলেন যে, নিজামউদ্দিন মানু্েষর  চোখে ধুলা দিয়ে প্রেমের কথা বলেন। জবাবে নিজামউদ্দিন বললেন, আপনারা নিশ্চয়ই সেই ঘুঘুর গল্প জানেন, যে তার সঙ্গীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করেনি। পুরুষ ঘুঘু আবেগে বলেছিল, তুমি যদি নিজেকে সমর্পণ না কর তাহলে আমি বাদশাহ সোলায়মানের সিংহাসন উল্টে দেব। তার কথা বায়ুতাড়িত হয়ে বাদশাহ সোলায়মানের দরবারে  পৌঁছলে বাদশাহ ঘুঘুকে ডেকে পাঠান। ঘুঘু বলেছিল, ‘হে আল্লাহর বান্দা, প্রেমিক-প্রেমিকার কথার কোনো ব্যাখ্যা আশা করা উচিত নয়।’ ঘুঘুর উত্তরে বাদশাহ সোলায়মান খুশি হয়েছিলেন। আমিও আশা করি, আমার উত্তরে সুলতান বলবন সন্তুষ্ট হবেন।’ নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কথা শুনে সম্রাটের দরবারে উপস্থিত সবাই বাহ বাহ করে উঠেন।

সর্বশেষ খবর