শিশুরাই আমাদের আগামী, আর তাই তাদের জন্য সবচেয়ে যথার্থ শিক্ষাপদ্ধতি কী হতে পারে, তা নিয়ে সারাবিশ্বেই বিস্তর গবেষণা চলছে। এটা এখন সবাই স্বীকার করছেন যে, কেবল ক্লাসরুম বা প্রথাগত পড়াশোনা একজন শিশুর যথাযথ বিকাশের জন্য যথেষ্ট নয়। এর পাশাপাশি তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আবেগীয় গুণাবলির পরিপূর্ণ বিকাশ নিশ্চিত করতে পাঠ্যক্রম বহির্ভূত নানা কার্যক্রমের প্রয়োজন রয়েছে।
শিক্ষার্থীকে সুস্থ-সবল রাখা, মেধা ও যোগ্যতা ব্যবহারের মাধ্যমে তাকে ভবিষ্যতের যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে তোলাই একটি যথার্থ শিক্ষাব্যবস্থার প্রধান উদ্দেশ্য।
একজন শিক্ষার্থী সবসময়ই নানা ধরনের শিক্ষার ভেতর দিয়ে যায়। তবে জন্মগ্রহণের পর থেকে শুরু করে প্রথম কয়েকবছরের মধ্যেই তার মস্তিষ্ক সুগঠিত হয়। এসময় ওই শিশু যেকোনো শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকে। শিশুর জন্য অত্যন্ত জরুরি এই সময়টিকে তাই শিক্ষাবিদরা খুবই গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। শিশুর এই সময়ের শিক্ষা তার পরবর্তী জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এই বিষয়গুলো বিবেচনা করে গত শতকের শুরুর দিকে বাস্তবতা-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আসেন ইতালিয় শিক্ষাবিদ মারিয়া মন্টেসরি। শিশুদের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর শিক্ষাপদ্ধতি হিসেবে সারাবিশ্বে এই পদ্ধতিটি মন্টেসরি’র নামে জনপ্রিয় হয়।
মন্টেসরি শিক্ষাপদ্ধতিতে বেশ কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমেই বিভিন্ন বয়সের শিশুদের নিয়ে একটি ক্লাস তৈরি করা হয়। এরপর এদের আগ্রহের বিষয়টি খেয়াল করে সে অনুযায়ী তাদের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়। তারা যেন স্বাধীনভাবে নিজেদের আগ্রহের বিষয়টি চর্চা করতে পারে তা নিশ্চিত করা হয়। ফলে ওই শিশুর মাঝে একইসাথে ব্যক্তিসত্ত্বা ও সহমর্মিতা খুব সহজেই তৈরি করা যায়। ওই শিশুর আগ্রহ রয়েছে এমন বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার ফলে তার মাঝে হাতে-কলমে শিক্ষাগ্রহণের উদ্দীপনা বৃদ্ধি পায়। তাদের এমনভাবে প্রস্তুত করা হয় যেন তারা বিশ্বের যেকোনো ক্ষেত্র থেকে নিজের পছন্দের বিষয়টি নিজে থেকেই শিখে নিতে সক্ষম হয়।
এখন বিশ্বের সব শিক্ষাপদ্ধতিই স্বীকার করে নিয়েছে যে শিশুদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের জন্য শরীর ও মন দু’টিতেই সমান মনোযোগ দেওয়া জরুরি। বিশেষত, শিক্ষার্থীদের শৈশবেই শারীরিক নানা কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলে, তাদের মধ্যে সমন্বয় ও মোটর দক্ষতা (হাঁটা, চলা-ফেরা ইত্যাদি) বিকশিত হয়। এতে করে পরবর্তী শিক্ষাগ্রহণের পর্যায়গুলো তাদের জন্য সহজ হয়ে আসে। নানান ধরনের খেলাধুলার মধ্য দিয়ে তাদের মাঝে নেতৃত্ব, সহযোগিতা, সহানুভূতি, দলগতভাবে কোনো কাজ সম্পন্ন করার মতো সামাজিক ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে। আর শৈশবের এই গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটি ওই শিক্ষার্থীর পরবর্তী সারা জীবনে বিভিন্নভাবে কাজে লাগে।
শিক্ষার প্রতি শিশুদের আরও মনোযোগী করে তুলতে ইদানীং সাঁতার ও স্কেটিংয়ের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্লি ইয়ারস প্রোগ্রাম। এ ধরনের শরীরচর্চা কেবল তাদের শরীরকেই সুস্থ রাখে না, একইসাথে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশেও সহায়তা করে। সাঁতার তাদের নিঃশ্বাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, অতিরিক্ত মেদ ঝরিয়ে সবল থাকতে সহায়তা করে। স্কেটিং তাদের মধ্যে ভারসাম্য, সমন্বয় ও খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হতে সাহায্য করে। মূলত বিজ্ঞানভিত্তিক মন্টেসরি শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমে তাদের শিখানো হয় কীভাবে একটি বিষয় একাগ্রভাবে শিখতে হয়। ফলে, যেকোনো নতুন কিছু শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই শিখে নিতে পারে।
একজন শিক্ষার্থীকে শৈশবেই বিকশিত করে তোলার ক্ষেত্রে পরিবার ও শিক্ষকই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা ক্লাসরুমে মন্টেসরির মতো বাস্তবসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগ করার মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীকে আরও যথাযথভাবে সহায়তা করা সম্ভব।
লেখক : হেড, প্রি-প্রাইমারি এবং গ্রেড ১ ও ২, গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল
বিডি প্রতিদিন/এমআই