৪ অক্টোবর, ২০২২ ১২:২৯

হবিগঞ্জের হাওরে দেখা মিলছে না দেশীয় মাছের

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

হবিগঞ্জের হাওরে দেখা মিলছে না দেশীয় মাছের

অপরূপ সৌন্দর্য আর হাওর বাওর বেষ্টিত একটি জেলার নাম হবিগঞ্জ জেলা। নানা কারণে এ জেলাটি দেশের অন্যান্য জেলা থেকে একটু ভিন্ন। এখানে যেমন রয়েছে সবুজ ঘেরা পাহাড় তেমনি রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ। ২৬৩৬. ৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়াতনের এ জেলায় ১৮ লক্ষাধিকের উপরে মানুষের বসবাস। উত্তরে সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলা, পূর্বে মৌলভীবাজার জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও পশ্চিমে কিশোরগঞ্জ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাথে রয়েছে হবিগঞ্জের সীমানা। আর সীমান্ত এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল বিশাল হাওর। হাওর অঞ্চল হওয়ায় বর্ষাকালে এখানকার অধিকাংশ মানুষের প্রধান কাজ হচ্ছে মাছ শিকার বা চাষ করা। একটা সময় এখানকার মিঠা পানির মাছ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী করা হতো ইউপরোপ আমেরিকাসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই। হাওরে আগের মতো দেখা মিলছে না দেশীয় মাছের। এছাড়াও বিলুপ্তির পথে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ। 

জানা যায়, জেলার আজমীরিগঞ্জ, লাখাই, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলায় বেশিরভাগ মানুষ মাছ শিকারের সঙ্গে বা মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। বর্ষা মৌসুমে এসব এলাকার মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় তারা বেছে নেন মাছ শিকার। এই জেলায় রয়েছে করাঙ্গী, বরাক, ভেড়ামোহনা, সুটকী, রত্না, বিজনা, খোয়াই, কুশিয়ারা, ঝিংড়ী, সুতাংসহ বিভিন্ন নদ-নদী। আরও আছে অসংখ্য খাল-বিল, ডোবাসহ নানা প্রাকৃতিক জলাশয়। আর এ কারণেই একটা সময় এখানে বেশি পরিমাণে মাছ পাওয়া যেতো। জলাশয়গুলোতে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শৈল, গজার, শিং, পাবদা, রুই, কাতল, চিতল, টেংরা, চিংড়ি, বোয়াল, বাউস, আইড়, টাকি, বাইন, পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতি মাছের কদরও ছিল বেশ। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটি হারাতে বসেছে। বিলুপ্তির পথে রয়েছে নানা প্রজাতির মাছ। এর মধ্যে রানী, কাকিয়া, পাবদা, বেদা, ঘাঘট, চাপিলা, ট্যাংড়া, চিতল, কালবাউশ, খালিশা, গুতুমসহ বেশ কিছু প্রজাতির মাছের এখন দেখাই মিলে না। 

মৎস্যচাষের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাওর এলাকায় অবৈধ কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, পোনা মাছ নিধন, পুকুর জলাশয় সেচের পর মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার এবং হাওরের মাঝ দিয়ে সড়ক নির্মাণের ফলে দিন দিন কমছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। সচেতন মহল মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে আরো কয়েক বছর পরে হয়তো দেশীয় মাছের দেখা’ই মিলবে না। তাই দেশীয় মাছ রক্ষা ও বিদেশে রপ্তানী বাড়াতে হলে এখনই পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও জেলায় রেজিস্ট্রিভুক্ত ৪১ হাজার ২৯৪ জন জেলেকে প্রনোদনার পাশাপাশি মাছ শিকারের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 

হবিগঞ্জ জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, জেলায় মাছের চাহিদা ৪৫ হাজার ৯২ দশমিক ১২ মেট্রিকটন। সার্বিক উৎপাদন হচ্ছে ৪৯ হাজার ৩৭৬ দশমিক ৪৬ মেট্রিকটন। জেলায় প্রাকৃতিক জলাশয়ের পরিমাণ ৮১ হাজার ৬৭১ হেক্টর। এক দশক আগে (২০১২ সালে) জেলায় দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৩ মেট্রিকটন। যা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ১৬৭ মেট্রিকটনে। অর্থাৎ গেল এক দশকে প্রাকৃতি জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কমেছে ৭ হাজার ৫২৬ মেট্রিকটন। তবে জেলায় বেড়েছে চাষ করা মাছের পরিমাণ। ২০১২ সালে ২৪ হাজার ২৬৪টি পুকুরের ৪ হাজার ১৯১ হেক্টর এলাকায় মাছ চাষ হতো ১৬ হাজার ১৪৫ মেট্রিকটন। বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৩১টিতে। যাতে ৫৮ হাজার ৯০ হেক্টর এলাকায় মাছের উৎপাদন হচ্ছে ২১ হাজার ৮৫৩ মেট্রিকটন। অর্থাৎ এক দশকে চাষ করা মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৫ হাজার ৭০৮ মেট্রিকটন। 

মাছ বিক্রেতা সুরেন্দ্র দাস বলেন, এখন মাছ শিকারের যত পদ্ধতি রয়েছে আগে তা ছিল না। এখন বিভিন্ন রকম নিত্য নতুন জালের আবিস্কার হয়েছে। যার ফলে হাওরের একেবারে তলদেশ থেকে শুরু করে উপরের মাছসহ সকল মাছ ধরে নিয়ে আসে। তিনি বলেন, বর্ষাকালে আগের মতো হাওরে পানি না হওয়ার ফলেও মাছের সংখ্যা কমে আসছে। অনুপম দাস বলেন, আগে পুকুর বা জলাশয় সেচ করলে কেউ কীটনাশক প্রয়োগ করতো না। যাতে করে মাটিতে থাকা ডিম ফুটে মাছ বাড়তো। কিন্তু এখন কীটনাশক প্রয়োগ করে মাটির তলদেশ থেকে মাছ তুলে আনা হয়। তিনি বলেন, যার ফলে এখন নানী, গুতুমসহ নানা প্রজাতির মাছেরই দেখা মিলে না। মাছ বিক্রেতা জলফু মিয়া বলেন, আমরা মাছ বিক্রি করে সংসার চালাই। কিন্তু যখন হাওরে মাছ ধরা পড়ে না তখন সরকার আমাদের দেখে না। তাই বাধ্য হয়ে পোনাসহ যা মাছ পাই তাই ধরে এনে বাজারে বিক্রি করি। 

হবিগঞ্জ জেলা মৎস কর্মকর্তা মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, কারেন্টজাল ও বেরজালসহ অবৈধ ভাবে মাছ শিকারীদের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। এছাড়াও মাছের সরবরাহ বাড়াতে বর্ষা মৌসুমে পোনা মাছ অবমুক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, তবে উপকূলের ন্যায় মাছের প্রজনন মৌসুমে হাওরের জেলেদের প্রণোদনা দিয়ে মাছ শিকার বন্ধ রাখার পরিকল্পনা চলছে। 

বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর