দ্বিতীয়বারের মতো ময়না তদন্ত করতে রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের ছাত্রী মালদ্বীপের মডেল রাউধা আতিফের লাশ কবর থেকে তোলা হয়। আজ সোমবার সকাল ৯টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর হেতেমখাঁ কবরস্থান থেকে রাউধার লাশ তোলা হয়। এর আগে সকাল ৮টার দিকে পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডির) কর্মকর্তারা কবরস্থানে যান। সিআইডি কর্মকর্তাদের মধ্যে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কাজী মো. শফি ইকবাল ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক আসমাউল হক উপস্থিত ছিলেন।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ডা. রক্তিম চৌধুরীর উপস্থিতিতে লাশ কবর থেকে তোলা হয়। পরে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করার পর বেলা পৌনে ১১টার দিকে লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাশের দ্বিতীয় ময়না তদন্ত শেষে সন্ধ্যায় পুনরায় লাশ দাফন করা হয়। লাশ তোলার সময় কবরস্থানে রাউধার বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফও উপস্থিত ছিলেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রথম ময়না তদন্তে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার মেয়ে হত্যাকাণ্ডের শিকার। দ্বিতীয় ময়না তদন্তে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলেও তিনি আশাবাদী।
ময়না তদন্তের জন্য গঠন করা মেডিকেল বোর্ডের প্রধান ছিলেন সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আমিরুল হোসেন চৌধুরী। অন্য দুই সদস্য সিরাজগঞ্জের নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব হাফিজ ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজের রেডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাফিজুর রহমান।
আজ দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত রাউধার ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্ত শেষে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সাংবাদিকদের বলেন, ‘মরদেহ কিছুটা ডিকম্পোস্ট (গলিত), কিছুটা সুরক্ষিত অবস্থায় আমরা পেয়েছি। আমরা দেহ পরীক্ষা করে যা পেয়েছি ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে তা বিস্তারিত লিখেছি। কিছু সফট টিস্যু, কিছু বোনস (হাড়), কিছু ভিসেরা সংরক্ষণ করেছি। দেহের এক্স-রে করা হয়েছে। এগুলোর প্রতিবেদন এলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা কোনো মতামত দেবো না।’ তিনি বলেন, ‘সফট টিস্যুর বেশির ভাগই গলিত ছিল।’ রাউধার বাবার দাবি অনুযায়ী গলায় অন্য কোনো দাগ ছিল কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দেহ অর্ধগলিত ছিল, তাই ওইভাবে কিছু বোঝা যায়নি।’
প্রথম ময়না তদন্তের সঙ্গে দ্বিতীয় ময়না তদন্তের কোনো পার্থক্য পেয়েছেন কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এ ব্যাপারে এখন আমরা কিছু বলতে পারব না। ভিসেরাসহ অন্যান্য প্রতিবেদন এলে সবকিছু মিলিয়ে আমরা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবো। তখন আমরা এ বিষয়ে কথা বলব।’
উল্লেখ্য, গত ২৯ মার্চ রাজশাহীর নওদাপাড়ায় ইসলামী মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হোস্টেল থেকে রাউধার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। রাউধা এ কলেজের এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। নীলনয়না রাউধা ছিলেন মালদ্বীপের একজন উঠতি মডেল। মাত্র একুশ বছরের রাউধার ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
রাউধার লাশ উদ্ধারের দিন কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানিয়েছিল, তিনি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এ ঘটনায় ওই দিনই কলেজ কর্তৃপক্ষ বাদী হয়ে নগরীর শাহমখদুম থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে। এরপর রামেকের মর্গেই রাউধার লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্তে তিন সদস্যর একটি মেডিকেল বোর্ডও গঠন করা হয়েছিল।
বোর্ডের তিন সদস্যর দু’জনই ছিলেন ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজের শিক্ষক। ময়নাতদন্তের পরদিনই তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, রাউধা আত্মহত্যা করেছেন। পরে মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত ও পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে গত ১ এপ্রিল রাউধার লাশ দাফন করা হয়। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়, রাউধাকে পরিকল্পিতভাবে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।
রাউধার বাবার অভিযোগ, ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা প্রকৃত ঘটনা আড়াল করে প্রতিবেদন দিয়েছেন। তার এই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা রাজশাহীতে এসে ঘটনা তদন্ত করেন। দেশে ফিরে গিয়ে তারা জানান, রাউধাকে হত্যার কোনো প্রমাণ তারাও পাননি। রাউধার মৃত্যুর ঘটনায় কলেজের পক্ষ থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সে কমিটিও তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, রাউধা আত্মহত্যা করেছেন। তবে গত ১০ এপ্রিল রাউধার বাবা ডা. মোহাম্মদ আতিফ রাজশাহীর আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এরপর থেকে তিনি রাজশাহীতেই অবস্থান করছেন।
হত্যামামলার এজাহারে বলা হয়েছে, রাউধাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। এ মামলায় রাউধার সহপাঠি সিরাত পারভীন মাহমুদকে (২১) একমাত্র আসামি করা হয়েছে। সিরাতের বাড়ি ভারতের কাশ্মিরে। সিরাতের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এখন পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সিআইডি বলছে, হত্যার প্রমাণ না মিললে গ্রেপ্তার করা হবে না সিরাতকে। তবে এরই মধ্যে তার পাসপোর্ট অকার্যকর করে দেওয়া হয়েছে। নজরদারির ভেতরেও রাখা হয়েছে তাকে। রাউধার মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্ত করছিলেন শাহ মখদুম থানার পরিদর্শক আনোয়ার আলী তুহীন। আর অপমৃত্যুর মামলাটি তদন্ত করছিলেন রাজশাহী মহানগর ডিবি পুলিশের পরিদর্শক রাশিদুল ইসলাম। রাউধার মৃত্যুর কারণ উৎঘাটনে তার কক্ষ থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ ও মোবাইলের ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য সেগুলো সিআইডির পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন রাশিদুল ইসলাম।
সে প্রতিবেদন এখনও ঢাকা থেকে আসেনি। এরই মধ্যে গত ১৩ এপ্রিল পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশে দুই মামলায় সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়। সিআইডির পরিদর্শক আসমাউল হক মামলা দুটি তদন্তের দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়েই তিনি রাউধার লাশের পুনরায় ময়নাতদন্তের উদ্যোগ নেন। এ জন্য লাশ কবর থেকে তুলতে সিআইডির এই কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন মঞ্জুর করেন। কিন্তু বোর্ড গঠন করার মতো চিকিৎসক না পাওয়ায় লাশ উত্তোলনে বিলম্ব হচ্ছিল। এরই মধ্যে সিআইডির কর্মকর্তারা রাউধার কক্ষের ফ্যানটি পরীক্ষার জন্য জব্দ করে। পাশাপাশি পুরো হোস্টেলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও জব্দ করা হয়। সেগুলো পরীক্ষা করছে সিআইডি। এ ছাড়া রাউধার সহপাঠীসহ হোস্টেলের কর্মকর্তা-কর্মচারিদেরও জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়েছে।
এরপর লাশের ময়না তদন্ত করতে সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আমিরুল চৌধুরী, সিরাজগঞ্জের নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক ডা. মাহবুব হাফিজ এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক হাফিজুর রহমানকে নিয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। এরপরই দাফনের ২৩ দিন পর সোমবার রাউধার লাশ কবর থেকে তোলা হলো।
বিডি প্রতিদিন/এ মজুমদার