রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে 'খালাসী' পদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে শনিবার থেকে। প্রথম দিনে অংশগ্রহণ করা ৬০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩০ শতাংশই বয়স্ক (৩৮ বছরের উপরে) বা বুড়া-বুড়ি। এ দৃশ্য লক্ষণীয়। এদের অধিকাংশই অষ্টম শ্রেণি পাস এবং 'জাল সনদধারী' বলে একাধিক শিক্ষার্থী সরেজমিনে অভিযোগ করেন। এতে আছেন অনেক রেল শ্রমিকলীগের আত্মীয়-স্বজন, রেলের ঠিকাদার, ব্যবসায়ী এবং দোকানরাও।
নিয়োগ কমিটির সদস্যরা জানান, পরীক্ষার্থীর তালিকা তৈরি করার আগেই যাচাই-বাছাই কমিটি করা হয়েছে। তারপর সেই অনুযায়ী মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। কোন পরীক্ষার্থী অনিয়ম ও জাল সনদের আশ্রয় নিয়ে চাকরি পেলে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে নিয়োগ বাতিল করা হবে।
নগরীর রেলওয়ে অফিসার্স ক্লাবে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৯টা থেকেই শুরু হয়েছে 'খালাসী' পদের মৌখিক পরীক্ষা। ১২৬টি পদের বিপরীতে প্রায় ২৬ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেলা ১২টার দিকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পরীক্ষার্থীদের একটি কক্ষে মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছেন কমিটির সদস্যরা। সুন্দর ও সু-শৃঙ্খল এ পরীক্ষায় সিরিয়াল মোতাবেক ডাকা হচ্ছে পরীক্ষার্থীদের। উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশই বয়স্ক বা বুড়া-বুড়ি। তাদের অধিকাংশের বয়স ৩৮ বছরের উপরে হবে।
লাইনে দাঁড়ানো মারজানা জান্নাত নামে একজন পরীক্ষার্থী বলেন, অনেক দূর থেকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য এসেছি। জানিনা চাকরিটা হবে কিনা।
পরীক্ষা শেষে বের হলে তিনি বলেন, 'সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। আশা করছি পাস করবো। তবে বাইরে দাঁড়ানো লোকজন বলছেন, এ নিয়োগের বিষয়ে কমিটির কেউ কিছু করতে পারবেন না। সব কিছু উপরে লাইন থাকলে চাকরি নিশ্চিত। তারপরও আশা নিয়েই চলে যাচ্ছি।'
প্রায় ৩৭ বছরের ঊর্ধ্বে আবদুল করিম (ছদ্মনাম) নামের একজন পরীক্ষার্থী বলেন, 'পাহাড়তলী ওয়ার্কশপ এলাকার দোকান রয়েছে। রেলে ব্যবসাও করি। তাই রেলের সবাইকে চিনি। পরীক্ষাটা শুধু উপস্থিতি, আর কিছু নয়। তাছাড়া এখানে বয়সটা বিষয় না।'
তিনি আরও বলেন, লাইন থাকলে সবকিছু হয়। তাছাড়া বর্তমানে বিভিন্ন দফতরে শ্রমিক নেতাদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই বয়স্ক হলেও চাকরি নিয়েছেন বিভিন্ন পদে। তারা চাকরি করছেন। রেলের বাসা-বাড়িও পেয়েছেন।' তবে পরিচয় জানার পর (সাংবাদিক) দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন তিনি।
চাকরি প্রত্যাশী সুমন বড়ুয়া (ছদ্মনাম) ক্ষোভের সাথে জানান, এখানে যত বয়স্ক পরীক্ষার্থী দেখছেন, তারা সবাই জাল সনদধারী পরীক্ষার্থী। টাকা দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে অষ্টম শ্রেণি পাস জাল সার্টিফিকেট তৈরি করে এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন অনেকেই। দেখা যাবে, তারাই চাকরি পাবেন। আর আমাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি হবে না।
পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) প্রকৌশলী আবদুল হাই বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রেলের সকল নিয়োগ পরীক্ষা সুন্দর ও সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য কমিটির দায়িত্বশীলরা কাজ করে যাচ্ছেন। সরকারি নিয়মানুযায়ী বয়স ও সনদ কোন ধরনের অনিয়ম হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সনদসহ সকল কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। এতে বয়োবৃদ্ধসহ বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের সনদ জাল কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করা হবে।
নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আবদুল জলিল বলেন, যাচাই-বাছাই কমিটি চূড়ান্ত করেই আমাদের তালিকা দিয়েছেন। সেই তালিকা অনুয়ায়ী মৌখিক পরীক্ষা নেয়া শুরু করেছি। তাছাড়া সনদে বয়স ঠিক থাকলে পরীক্ষার্থীরা বয়স্ক হলেও আমাদের কিছু করার নেই।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মচারী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, নিয়োগ কমিটির সদস্যদের মধ্যে বিতর্কিত সদস্যও রয়েছে। নানাবিধ অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও একটি চক্র নিজেদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে সু-কৌশলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এসব কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন।
এসব বিষয়ে মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়েছে। চিহ্নিত কিছু লোকের কারণে সরকারের নির্দেশনায় মন্ত্রী ও সংসদীয় কমিটির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। একই সাথে আবার নানাবিধ হয়রানি আতঙ্কে অনেক কর্মকর্তা নিয়োগ কমিটিতে থাকতে রাজিও হচ্ছেন না।
জানা যায়, রেলওয়ের বিভিন্ন ক্যাটাগরির নিয়োগের সময় অনিয়ম, দুর্নীতি প্রকাশ্যে রূপ নিয়েছে। এসব বিষয়ের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সাবেক জিএম ইউসুফ আলী মৃধাসহ কয়েকজন কর্মকর্তা চাকরিচ্যুতও হয়েছিল। বর্তমানে কারাগারে রয়েছে মৃধা। চলছে দুদকের তদন্তও। তারপরও থেমে নেই নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানাবিধ অনিয়ম। ইতিমধ্যে প্রধান বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেনের বিরদ্ধে দুদক ও টেন্ডার জালিয়াতির বিষয়ে রেলের পৃথক দুটি তদন্তও চলছে।
বিডি প্রতিদিন/২৬ আগস্ট ২০১৭/আরাফাত