ঈদুল আজহা সামনে রেখে রাজধানীতে অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বেড়েছে। ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে নিত্যনতুন কৌশল গ্রহণ করা এ পার্টির সদস্যরা।
প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীর কোথাও না কোথাও অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সর্বস্ব হারানোর পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। গত এক মাসে শতাধিক ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনই মারা গেছেন। সর্বশেষ নিউমার্কেটে আক্রান্ত এক ব্যক্তি গতকাল হাসপাতালে মারা যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাস, লঞ্চ, ট্রেনস্টেশন ও রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা অচেতন ব্যক্তিদের উদ্ধার করা হচ্ছে। এদের বেশির ভাগই ঢামেক, মিটফোর্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে তা খুবই বিপজ্জনক। এসব ওষুধের প্রতিক্রিয়া মানুষের জীবন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। এমনকি অনেকের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাও দুষ্কর হয়ে উঠতে পারে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজধানীর প্রায় ২০টি পয়েন্টে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের বেশির ভাগই মৌসুমি অজ্ঞান পার্টির সদস্য। কয়েকটি চক্রকে চিহ্নিত করতে পারলেও তাদের ধরতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ।
সূত্র জানায়, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ফুটপাত, লঞ্চঘাট, রেল বা বাসস্টেশন, হাটবাজার ইত্যাদি জনবহুল জায়গায় হকার হিসেবে অবস্থান করে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য—যেমন ডাবের পানি, জুস, চা, কফি, পান, খেজুর, ঝালমুড়ি, শক্তিবর্ধক হালুয়া, ক্রিমজাতীয় বিস্কুট, চকোলেট, রঙিন পানীয় ইত্যাদি বিক্রি করে। আবার কখনো এরা যাত্রীবেশে লঞ্চ, বাস বা ট্রেনে উঠে সরাসরি কারও সঙ্গে সখ্য তৈরি করে অজ্ঞানকারী খাদ্যদ্রব্য খাইয়ে মূল্যবান সামগ্রী নিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, কোমল পানীয় কিংবা বোতলজাত খাওয়ার পানির সঙ্গে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহূত ইনসুলিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় অজ্ঞান করার রেসিপি। আবার গণপরিবহনে সিটের কাছে ক্লোরোফোম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করার কাজটি করা হয়। ঈদ সামনে রেখে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে ‘অপারেশন’ পরিচালনা করছে। ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের নির্দিষ্ট গ্রুপ রয়েছে। বিভিন্ন ধর্মীয় বা বড় কোনো অনুষ্ঠান সামনে রেখে তারা তৎপর হয়ে ওঠে। এ সময় মানুষ নগদ অর্থ নিয়ে বেশি চলাফেরা করে থাকে। প্রতিনিয়ত অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে দলে নিত্যনতুন সদস্য যোগ হওয়ায় কিছুটা বেগ পেতে হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, কোরবানির ঈদে গরুর ব্যাপারিরা নগদ অর্থ লেনদেন করেন। ফলে গরুর হাটকেন্দ্রিক এ পার্টির সদস্যরা তৎপর হয়ে ওঠে। এ ছাড়া বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে এদের তৎপরতা বাড়ে। এরা সাধারণ মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্বান্ত করছে। অজ্ঞান পার্টির এসব সদস্যকে ধরতে র্যাব সদা তৎপর। ঘটনা সূত্রে দেখা গেছে, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তারা একটি এলাকা থেকে বাস বা অন্য কোনো গণপরিবহনে উঠেছেন। সেখানে তাদের নিত্যনতুন কৌশলে অজ্ঞান করা হয়েছে। মাওয়া থেকে গুলিস্তান-সায়েদাবাদ রুট, কাঁচপুর-নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ ও গুলিস্তান, গাজীপুর থেকে আবদুল্লাহপুর, মহাখালী ও সাভার থেকে গাবতলী, মিরপুর ও চিড়িয়াখানা রুটের বাসগুলোতে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বেশি সক্রিয়। এ ছাড়া পল্টন, শাহবাগ, মোহাম্মদপুর, চানখাঁরপুলসহ রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে চক্রটি কাজ করছে। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মাঝেমধ্যে অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে। অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা গ্রেফতার হওয়ার পরই তাদের তড়িঘড়ি করে জামিনে মুক্ত করার জন্য একটি চক্র জোর তদবির চালায়। ফলে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে একই পেশায় ফিরে যাচ্ছে। গতকাল ভোরে ঢামেক হাসপাতালে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়া অজ্ঞাত (৬৫) এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। পুলিশ বলছে, জ্ঞান না ফেরায় তার পরিচয় পাওয়া যায়নি। ওই ব্যক্তিকে উদ্ধারকারী টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহকারী অধ্যাপক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের সায়েন্স ল্যাব থেকে বাহন পরিবহনে ওই ব্যক্তি অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন। আমিও ওই বাসের যাত্রী ছিলাম। অনেকে দেখলেও কেউ ধরেনি। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়া হয়। ’
১৮ আগস্ট যাত্রাবাড়ীর সাদ্দাম মার্কেট এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে মাসুদ আহামেদ (৪০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। মৃতের বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ থানার জালালসাহেব গ্রামে। ১ আগস্ট গুলিস্তানে অজ্ঞান পার্টির খপ্পড়ে পড়ে শামসুদ্দিন নামে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) এক সদস্যের মৃত্যু হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা যেসব ওষুধ ব্যবহার করছে তা খুবই বিপজ্জনক।
বিডি প্রতিদিন/২৮ আগস্ট ২০১৭/এনায়েত করিম