ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। রাজধানীতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের দলীয় সমাবেশ সফল করতে সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন তিনি। মিছিলে থাকতেন সামনের সারিতে। দলীয় নেতা-কর্মীদের সংগঠিত করতেও রেখেছেন ভূমিকা। কারো কাছে শ্রেষ্ঠ সংগঠক, আবার কারো চোখে মানবিক যুবনেতা সম্রাট।
সবকিছু ঠিকই চলছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর ভোরে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে সম্রাট ও তার সহযোগী এনামুল হক আরমানকে গ্রেফতার করে র্যাব। ওই দিনই রাত পৌনে ৯টার দিকে অস্ত্র, অর্থ পাচার ও মাদক মামলা সম্রাটকে কারাগারে নেয়া হয়। পরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় কারাগারেই ছিলেন সম্রাট। প্রায় আড়াই বছর ধরে নেতা-কর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় সম্রাটের অনুসারীরা অনেকটা নিরাশ, দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। আবার ‘ভাই’ ফিরে আসবেন এমন খবরে উচ্ছ্বাসিত নেতা-কর্মীরা।
১১ মে বুধবার অস্ত্র, অর্থ পাচার ও মাদক মামলার পর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান সম্রাট। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান তার জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন শুনানিতে আদালতপাড়ায় জড়ো হয়েছিলেন সম্রাটের অর্ধশতাধিকেরও বেশি অনুসারী। জামিন হয়েছে, ভাইকে দীর্ঘদিন পর মুক্ত অবস্থায় ফিরে পাবেন। এই আশায় আনন্দে উদ্বেলিত হন। এজলাস থেকে বের হয়ে খুশিতে কোলাকোলিও করেন তারা। এসময় অনেককে আনন্দে কাঁদতেও দেখা যায়।
এরকমই একজন যাত্রাবাড়ির বাসিন্দা ও মহানগর ছাত্রলীগ কর্মী সাজ্জাদ হোসেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর নেতা মুক্ত হচ্ছেন। আমরা সবাই খুশি। হাজার হাজার নেতা-কর্মী খুশি। এ আনন্দ বলে বুঝানো যাবে না।
ছাত্রলীগ নেতা মেহেদি হাসান বলেন, সম্রাট ভাই দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। অনেক আগে হার্ট সার্জারিও হয়েছে। ঠিক মতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। তিনি একজন মানবিক নেতা। প্রতি রমজানে হতদরিদ্রদের ফ্রিতে খাওয়াতেন। মিডিয়ায় অনেক কিছুই লেখা হয় কিন্তু এলাকার মানুষ জানে তিনি কি রকম মানুষ।
শুধু এজলাসের বাইরেই নয়, তৎক্ষণাত পুরো আদালতপাড়ায় যুবলীগ নেতা সম্রাটের জামিনের বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে। মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে মতিঝিল থেকে আসা জুবায়ের টিপু পরিচিতজনকে মুঠোফোনে বলছিলেন, একটু আগে ভাইকে (সম্রাট) জামিন দিছে। টিপু বলেন, রমজানে মাসে সব মামলায় সম্রাট ভাইয়ের জামিন হয়ে গেছে। শুধু একটা মামলা বাকি ছিলো। আমরা মনে করেছিলাম ঈদের আগে ভাই বেরিয়ে আসবে। যাই হোক হয়নি, আজ জামিন হয়েছে। এতেই আমরা খুশি।
এর আগে সকাল পৌনে ১০টায় অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার বিশেষ জজ আদালতে আনা হয় ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাকে মহানগর দায়রা জজ আদালতের হাজতখানা থেকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামানের এজলাসে তোলা হয়। এসময় দেখা যায়, পুলিশ সদস্যরা সম্রাটের হাত ধরে বিচারকের কক্ষ পর্যন্ত নিয়ে আসেন। টি-শার্ট, প্যান্ট পরা সম্রাটের ডান হাতে ছিল ক্যানোলা লাগানো। ধীর গতিতে হাঁটতে দেখা যায় তাকে। প্রায় আধা ঘন্টা চলে শুনানি। এই পুরোটা সময় এজলাসে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি।
আদালতে শুনানিতে অংশ নিয়ে সম্রাটের আইনজীবীগণ মানবিক দিক বিবেচনায় তার জামিনের আবেদন জানান। পরে আদালত দীর্ঘ হাজতবাস ও স্বাস্থ্যগত কারণ বিবেচনায় সম্রাটের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন।
সম্রাটের আইনজীবী মাহবুবউল আলম দুলাল বলেন, আদালত তিনটি শর্তে অন্তর্বতীর্কালীন জামিন দিয়েছেন। শর্ত তিনটি হলো- আদালতের অনুমতি ব্যতীত সম্রাট বিদেশ যেতে পারবেন না, তার পাসপোর্ট আদালতে জমা দিতে হবে এবং জামিনের পর নির্ধারিত তারিখে মেডিকেল রিপোর্ট জমা দিতে হবে। তিনি বলেন, এর আগে অন্যান্য মামলাগুলোতে জামিন পাওয়ায় তার মুক্তিতে এখন আর কোনো বাধা নেই।
সম্রাটের পারিবার সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে চিকিৎসক দেবী শেঠীর অধীনে সম্রাটের ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে হার্টে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। তখন থেকে সম্রাট অসুস্থ শরীর নিয়েও দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। সম্রাটকে গ্রেফতারের পর ২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তার মা
সাহেরা খাতুন চৌধুরী বলেন, সম্রাট শেখ হাসিনার পরীক্ষিত সৈনিক, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের লোক। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে ছিলেন সম্রাট। ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের সভা-সমাবেশ সফল করতে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন সম্রাট। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা এবং ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে তার ছেলেকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে জড়ানো হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. রায়হান মাসুম মণ্ডলের অধীনে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট সিসিইউতে চিকিৎসাধীন। ডা. রায়হান মাসুম বিবার্তাকে বলেন, ১৯৯৮ সালে চিকিৎসক দেবী শেঠীর অধীনে তার (সম্রাটের) ওপেন হার্ট সার্জারির মাধ্যমে ভালভ প্রতিস্থাপন করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি বেশ জটিল একটা সার্জারি। কারা সেলে পর্যাপ্ত সাপোর্ট না থাকায় আমরা তাকে সিসিইউতে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে আসছিলাম। তার হৃৎস্পদন বেশ অস্বাভাবিক। তাই সব মামলায় জামিন পেলেও হাসপাতাল থেকে এখনই ছাড়া পাচ্ছেন না তিনি। আমরা দেখবো হোম পরিবেশে তার শরীর সাপোর্ট করে কিনা। তার পালস রেট এবং রিদমে সমস্যা আছে কিনা। এই ব্যাপারগুলো নিশ্চিত হতে আরো বেশ কিছুদিন অবজারবেশনে থাকা দরকার। এরপরই আসলে বলা যাবে তিনি কখন হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবেন।
যুবলীগ নেতা-কর্মীরা জানান, রাজধানীতে আওয়ামী লীগের দলীয় সমাবেশ সফল করতে সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো সম্রাটের। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত নানা কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের নেতৃবৃন্দ এবং সম্রাটের অনুসারীদের আধিক্যই বেশি দেখা যেতো। আর এসব কারণে সম্রাটকে ‘শ্রেষ্ঠ সংগঠক’ও ঘোষণা করা হয়। তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন যুবনেতা সম্রাট। দলের নানা কর্মসূচিতে হাজারো নেতাকর্মী হাজির করে সবসময় একজন দক্ষ সংগঠকের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। তার সময়েই ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল।
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করে তাকে কাকরাইল অফিসে নেয়া হয়। তল্লাশি চলার সময় কোনো গণমাধ্যমকর্মীকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। ওই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু লোককে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে অফিসে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এঘটনা কেবল রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এবং ব্যক্তিগত আক্রোশে সম্রাটকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। তার গ্রেফতারের পরপরই সম্রাটের মুক্তি চেয়ে পুরো নগরজুড়ে পোস্টার সেঁটে দেয় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগ এবং তার অনুসারীরা।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, সম্রাট ছাত্রাবস্থায় জড়িয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে। নব্বইয়ের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে ছাত্রলীগের রাজনীতি সক্রিয় হন তিনি। পরে যুক্ত হন যুবলীগের সাথে। ৫৩ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে রমনা থানা যুবলীগের আহবায়ক হন সম্রাট। ২০০৩ সালের সম্মেলনে মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ২০১২ সালে যুবলীগের ৬ষ্ঠ কাউন্সিলে তিনি যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি নির্বাচিত হন।