বরিশাল সিটি কর্পোরেশন (বিসিসি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে এবং ১৫ আগস্টের শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছোট ছেলে আবুল খায়ের আবদুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। সেরনিয়াবাত পরিবারের মধ্যে মনোনয়ন দেয়ায় খুশী স্থানীয় জনসাধারণসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তবে মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর চুপসে গেছেন বিদায়ী মেয়রের ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা।
স্বাধীনতা পরবর্তী বরিশাল আওয়ামী লীগের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত পরিবার। বাম রাজনীতিক রব সেরনিয়াবাতকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়ে ৬৯ সালে এমএনএ নির্বাচিত করতে ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতার পর গৌরনদী থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বপরিবারে নিহত হওয়ার আগে কৃষিসহ ৩টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন রব সেরনিয়াবাত। ওই কালোরাতে বিসিসি’র নতুন মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। একই ঘটনায় বর্তমান মেয়র শিশু সাদিককে কোলে নিয়ে মা শাহানআরা বেগম গুলিবিদ্ধ হয়ে বেঁচে গেলেও তার বড় ছেলে সুকান্ত শহীদ হন।
এর আগে রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ৭৩ সালে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বরিশাল পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাসানাত। ৯৬ সালে জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ এবং বর্তমানে পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করছেন তিনি।
রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সব শেষ ২০১৮ সালের ৩০ জুলাইয়ের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান সেরনিয়াবাত পরিবারের উত্তরসূরি জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির বড় ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ। ৫ প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোট বর্জনের মধ্যে এক তরফা নির্বাচনে সাদিক আবদুল্লাহ ১ লাখ ৭ হাজার ৩৫৩ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্য সাদিক মেয়র নির্বাচিত হওয়ায় বরিশাল নগরীর ব্যাপক উন্নয়ন হবে বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু গত সাড়ে ৪ বছরে বিসিসি’র একটি প্রকল্পেও অর্থ বরাদ্দ দেয়নি সরকার। তখন থেকেই কানাঘুষা ছিল মেয়র সাদিককে পছন্দ করছেন না প্রধানমন্ত্রী। তার উপর প্রধানমন্ত্রীর আর্শীবাদ না থাকায় উন্নয়ন বঞ্চিত বরিশালের মানুষ।
এবারের বিসিসি নির্বাচনে তফসিল ঘোষণার পর বর্তমান মেয়রসহ ৭ জন দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। যার মধ্যে প্রথমবারের মতো কোন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ফর সংগ্রহ করেন হাসানাতের ছোট ভাই তথা মেয়র সাদিকের চাচা আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত। যিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই।
শুরু থেকেই মনোনয়ন পাবার বিষয়ে আশাবাদী ছিলেন খোকন সেরনিয়াবাত। শনিবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় বরিশাল সিটিতে খোকন সেরনিয়াবাতকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় বরিশালের দৃশ্যপট। এতদিন যারা সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন চেয়ে বিলবোর্ড-ব্যানার সাঁটিয়েছিলেন তারা এখন মুখ লুকাচ্ছেন। থাকছেন আড়ালে আবডালে।
সিটির মনোনয়নের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি একেএম জাহাঙ্গীরের মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করীম বলেন, প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি পার্লামেন্টারী বোর্ডের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই সিদ্ধান্তের বাইরে তো আমরা না। নৌকার বাইরে আমাদের কোন রাজনীতি নেই। নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতে পারে। নৌকার বাইরে কোন প্রতিযোগিতা নেই। নৌকা যেখানে আমরা সেখানে।
সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন না পাওয়ার বিষয়ে অ্যাডভোকেট আফজাল বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। তিনি দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক। তার মনোনয়ন ক্রয়ের সময় আমরা গিয়েছিলাম। জমা দেয়ার সময়ও ছিলাম। সবাই তার পক্ষে কাজ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। এখন বোর্ড তাকে বিবেচনা করেনি, সেখানে তো আমাদের কিছু করার নেই।
বিসিসি নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সাবেক এমপি তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, আমরা আওয়ামী লীগ করি। আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তই আমাদের সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মনোনয়ন বোর্ডের সভায় যে সিদ্ধান্ত হয়েছে আমরা সেই সিদ্ধান্তের বাইরে না। আওয়ামী লীগের সবাই নৌকার কর্মী।
মনোনয়ন নিয়ে কোন ক্ষোভ আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে অ্যাডভোকেট ইউনুস বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব মেনে নিয়েই সবাই আওয়ামী লীগ করে। তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সবাই কাজ করে। এখানে ক্ষোভ আপেক্ষের কোন বিষয় নেই।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশালের (সনাক) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল। সব ক্ষেত্রে তাদের গবেষণা আছে। তাদের মনোনয়ন বোর্ডের সকল সদস্য প্রবীণ এবং অভিজ্ঞ রাজনীতিক। আজ তাদের মনোনয়ন বোর্ড দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। এতে দলীয়ভাবে তারা লাভবান হবেন। বরিশালের নাগরিকরাও আগামীতে উপকৃত হবে।
দলীয় মনোনয়ন পাবার বিষয়ে ১৫ আগস্টের গুলিবিদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, বরিশালের মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং চাওয়া ছিল তার মনোনয়ন। মানুষের দোয়াতেই আমি মনোনয়ন পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী বড় নেত্রী। উনি বুঝতে পেরেছেন বরিশালের অবস্থাটা কি। শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেছেন বরিশালবাসীর জন্য আমাকে প্রয়োজন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানাই।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত