বৃহস্পতিবার, ৪ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

বড় দুর্ঘটনায় ফুটে ওঠে দুর্বলতা

ফায়ার সার্ভিস সপ্তাহ শুরু ♦ সক্ষমতা বেড়েছে : ডিজি, পদক পাচ্ছেন ৩৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী

আলী আজম

অগ্নিকান্ড, দুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে অন্যতম ভরসা ফায়ার সার্ভিস। ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে সবার আগে পাশে দাঁড়ায় এই বাহিনী। হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে নিজেদের জীবন বাজি রাখতেও কার্পণ্য করে না। কিন্তু দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রত্যাশার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি সংস্থাটি। উল্টো জনবল সংকট, উন্নত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক সরঞ্জামের অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই ফুটে ওঠে দুর্বলতা। বিশেষ করে সুউচ্চ ভবন, কলকারখানা কিংবা কেমিক্যাল গোডাউনের মতো জায়গায় বড় অগ্নিকান্ড ও ভবন ধসের ঘটনায় দুর্বলতাগুলো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এই বাস্তবতা সামনে রেখে আজ থেকে সারা দেশে শুরু হচ্ছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ-২০২১। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মুজিব বর্ষে শপথ করি, দুর্যোগে জীবন-সম্পদ রক্ষা করি’। রাজধানীর মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের প্যারেড গ্রাউন্ডে আজ সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। এ উপলক্ষে মহড়া ও গণসংযোগ আয়োজন, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, যান্ত্রিক শোভাযাত্রা, লিফলেট ও পোস্টারসহ নানা প্রচারপত্র বিতরণ এবং বিভিন্ন পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করা হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। 

পদক পাচ্ছেন ৩৭ কর্মকর্তা কর্মচারী : ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ৩৭ জন কর্মকর্তা/কর্মচারীকে তাদের সাহসিকতা, ঝুঁকিপূর্ণ ও সেবামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক, প্রেসিডেন্ট ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক এবং বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স পদক, বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স (সেবা) পদক প্রদান করা হয়েছে। আজ তাদের হাতে পদক তুলে দেওয়া হবে।

বড় অগ্নিকান্ডে দুর্বলতা : কয়েক বছরে বিভিন্ন বহুতল ভবন, কলকারখানা ও কেমিক্যাল গোডাউনে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দুর্বলতা ফুটে ওঠে ফায়ার সার্ভিসের। আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগায় বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে হতাহতদের পরিবার ও স্থানীয়দের। বিশেষ করে গত ৮ জুলাই বিকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ২৯ ঘণ্টা সময় লাগে ফায়ার সার্ভিসের। ততক্ষণে ছয় তলা ভবনের পুরোটাই আগুনের তান্ডবে ধ্বংসলীলায় পরিণত হয়। ৪র্থ তলায় আগুন ছড়াতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগলেও সেখানে আটকা পড়া ৪৯ শ্রমিক পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায়। এ ছাড়াও গত বছরের ৫ নভেম্বর রাজধানীর ডেমরায় কোনাপাড়া মাদরাসা রোডে পাশা টাওয়ারের ১০তলা ভবন এবং ২০১৯ সালে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ভয়াবহ অগ্নিকান্ড এবং একই বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফ আর টাওয়ারের অগ্নিকান্ড নিয়ন্ত্রণেও হিমশিম খেতে দেখা যায় ফায়ার সার্ভিসকে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। আন্তর্জাতিক মানের সব ধরনের সরঞ্জাম আমাদের আছে। যদি পাশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়, সেদিক থেকেও আমরা পিছিয়ে নেই। তবে, প্রশিক্ষণের বেলায় অনেক ঘাটতি রয়েছে, এটা সত্য। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুন্সীগঞ্জে বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ২০২০ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৩টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে ৭ হাজার ৭২৯টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে।

 চুলার আগুন থেকে ৩ হাজার ৫৬৪টি, বিড়ি-সিগারেটের টুকরো থেকে ৩ হাজার ৪৬৪টি, মেশিনের মিস ফায়ার থেকে ১৭৩টি, গ্যাস সিলিন্ডার ও বয়লার বিস্ফোরণে ১৩৫টি, গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ৭২২টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ১৫৪ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৯৩ জন পুরুষ, ৭৮ জন নারী এবং ফায়ার সার্ভিসের ১৫ জন কর্মকর্তা কর্মচারী। এসব ঘটনায় মোট ক্ষতির পরিমাণ ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। মোট উদ্ধারের পরিমাণ ১ হাজার ৪২৬ কোটি ১৮ লাখ টাকারও বেশি।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিকান্ডের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাপণের জন্য আধুনিক ফায়ার স্টেশন নির্মাণের পাশাপাশি বাড়ানো হচ্ছে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা। ১০ বছর আগে সারা দেশে ২০৪টি ফায়ার স্টেশন থাকলেও বর্তমানে সারা দেশে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা ৪৫৬টি। পাশাপাশি ঢাকা, গাজীপুর নারায়ণগঞ্জ ও রূপপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণ করা হচ্ছে ১১টি আধুনিক ফায়ার স্টেশন। ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা বাড়লেও সেই অনুপাতে বাড়েনি জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম। বর্তমানে সংস্থাটির জনবল রয়েছে ১৩ হাজার ৪৭৩ জন। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। জানা গেছে, প্রথম শ্রেণির ফায়ার স্টেশনগুলোতে ৩৫ জন করে জনবল থাকার কথা। এর মধ্যে ফায়ারম্যান থাকার কথা ২২ জন। কিন্তু বাস্তবে ১৫-১৬ জনের বেশি ফায়ারম্যান নেই প্রথম শ্রেণির স্টেশনেও। দ্বিতীয় শ্রেণির ফায়ার স্টেশনের অবস্থা আরও করুণ। ফায়ার সার্ভিসের সংকট কাটাতে কমপক্ষে ৩০ হাজার জনবল দরকার বলে মনে করেন শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, আধুনিক সরঞ্জামের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। বর্তমানে সারা দেশে ল্যাডার (মই) রয়েছে ২১টি। ঢাকায় রয়েছে মাত্র ১১টি। এর মধ্যে সম্প্রতি সর্বোচ্চ ৬৪ মিটারের ৫টি ল্যাডার যুক্ত হয়েছে। এগুলো ২২তলা পর্যন্ত আগুন নির্বাপণে সক্ষম। এ ছাড়াও ৫৪ মিটার ও ২৭ মিটারের ল্যাডার রয়েছে। বিশেষায়িত গাড়িও বাড়ানো হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসে বিশেষায়িত গাড়ি এখন প্রায় ৬০০টি। এ ছাড়াও রাতে অভিযান পরিচালনার জন্য হেভি ডিউটি লাইট ইউনিট, রিমোট কন্ট্রোল অপারেশন ভিহাইক্যাল, কেমিক্যালে আগুন নির্বাপণে সক্ষম ৫টি অত্যাধুনিক গাড়ি, ওয়াটার রেস্কিউয়ের জন্য রাবার বোট, বহুতল ভবনে রেস্কিউ করার জন্য ৩০ মিটার গভীরে কাজ করতে সক্ষম হ্যামার যোগ করে দুর্বলতা কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর