বুধবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা
ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে ফাঁদ

ভয়ংকর ১১ প্রতারকের চক্র

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেসবুকে পরিচয়, তারপর বন্ধুত্ব, কখনো প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যোগাযোগ শুরু। এরপর হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপেও আলাপচারিতা। একপর্যায়ে পার্সেল, ডলার, চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রলোভন। নাইজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়াসহ বেশ কিছু দেশের প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে কোটি কোটি টাকা খুইয়েছেন দেশের অনেক মধ্যবিত্ত থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তি। বিদেশি প্রতারক চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পার্সেল প্রতারণায় বাংলাদেশের মূল মাস্টারমাইন্ড বিপ্লব লস্কর। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিদেশি প্রতারকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশের মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। হয়েছেন বিপুল সম্পত্তির মালিক। পার্সেল প্রতারণা চক্রের মূল হোতা বিপ্লব লস্করসহ ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা বলছেন, চক্রের মূল হোতা বিপ্লব গ্রেফতার এড়াতে গাড়িতে ও তার সঙ্গে সব সময় নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করতেন। এ কারণে দীর্ঘদিন ধরেও তাকে গ্রেফতার করা যায়নি। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- সুমন হোসেন ওরফে ইমরান, মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন, ইমরান হাসান ওরফে ইকবাল, নাজমুল হক রনি, মোসা. নুসরাত জাহান এবং নাইজেরিয়ান নাগরিক চিডি, ইমানুয়েল, জন, অ্যাঙ্গোলিয়ার নাগরিক উইলসন ডে কনসিকাউ ও ক্যামেরুনের নাগরিক গুলগ্নি পাপিনি। সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি, একটি ম্যাগাজিন, ২৮টি মোবাইল, একটি কম্পিউটার, ৪৯১টি এটিএম কার্ড, ২৬টি চেকবই, তিনটি ওয়্যারলেস পকেট রাউটার, একটি প্রাইভেটকার, সাড়ে ৩ লাখ জাল টাকা, ১১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ও ২৬৩টি সিমকার্ড জব্দ করা হয়। ডিবি বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৫ বছর ধরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন বিপ্লব। একসময় গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে কুলির কাজ করতেন বিপ্লব। ২০০০ সালে ঢাকায় এসে মিরপুরে ফুটপাতে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। পরিচয় হয় মিরপুরে বসবাসরত কয়েকজন নাইজেরিয়ানের সঙ্গে। ২০০৭ সালে প্রতারণার জগতে পা রাখেন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হিসেবে। রূপগঞ্জের পূর্বাচলে বিলাসবহুল এক ডুপ্লেক্স বাড়ির মালিক বিপ্লব। এ ছাড়া রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট। বিদেশিদের প্রতারণার শতাধিক ঘটনার সঙ্গে বিপ্লবের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।

 প্রতারণার পথ দেখিয়ে শতকোটি টাকা বিদেশিদের কাছে তুলে দিয়েছেন বিপ্লব। এই লাইনে তিনি ‘বিগ বস’ নামে পরিচিত। প্রতারক চক্রের অধিকাংশ সদস্য তার নাম জানলেও সরাসরি তাকে দেখেননি। গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ।

 তিনি বলেন, পার্সেল প্রতারক কখনো বাংলাদেশে বসে আবার কখনো দেশের বাইরে থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বন্ধুত্ব গড়ে পার্সেলে ডলার অথবা মূল্যবান উপহার পাঠানোর ফাঁদ পেতে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রতারক চক্রের দেশি-বিদেশি সদস্যরা বিভিন্ন পন্থায় সাধারণ মানুষের ফেসবুক আইডি, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেইল সংগ্রহ করে ইউএস আর্মি, ইউএস নেভিসহ বিভিন্ন পরিচয় ব্যবহার করে টার্গেট ব্যক্তিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্কের একটি পর্যায়ে দামি উপহার হিসেবে স্বর্ণ, মূল্যবান পাথর, হীরা, বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা, ডলার/ইউরো ইত্যাদি পাঠানোর কথা বলে ফাঁদে ফেলে তারা। এরপর সেগুলো ব্যক্তির নাম-ঠিকানা উল্লেখ করে ভুয়া পার্সেলের ছবি পাঠায়। প্রতারিত ব্যক্তিরা সরল বিশ্বাসে পার্সের গ্রহণের অপেক্ষায় থাকেন। প্রতারক চক্রের কলিং বিভাগে কর্মরত বাংলাদেশি প্রতারকরা বিভিন্ন অপারেটরের নম্বর ব্যবহার করে নিজেকে কাস্টমস অফিসার পরিচয় দিয়ে জানায়, কিং এক্সপ্রেস সার্ভিস থেকে একটি পার্সেল এসেছে। পার্সেলটি ছাড়াতে কাস্টমস হাউস ফি বাবদ মোটা অঙ্কের টাকা পরিশোধ করতে হবে। পার্সেল পাওয়ার আশায় কাস্টমস কর্মকর্তার দাবি করা টাকা পাঠিয়ে দেন ভুক্তভোগীরা। এরপর কাস্টমস কর্মকর্তা পরিচয় দানকারী ব্যক্তি আবারও ফোন করে জানায়, বিদেশি বন্ধুর পাঠানো পার্সেলে বিপুল পরিমাণ অবৈধ ডলার রয়েছে, যা ছাড়াতে আরও বেশি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা দিতে ব্যর্থ হলে ভুক্তভোগী ব্যক্তির নামে মানি লন্ডারিং আইনসহ অন্যান্য আইনে মামলা হবে বলে মিথ্যা ভয়ভীতি দেখানো হয়। প্রতারিত ব্যক্তিরা মামলার ভয়ে প্রতারকদের দেওয়া বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দাবি করা টাকা পাঠালে আবারও ফোন করে পুলিশ ও সাংবাদিক জেনে যাওয়ায় তাদের ম্যানেজের কথা বলে আরও বড় অঙ্কের টাকা দাবি করে এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করতে থাকে প্রতারকরা। দাবি করা টাকা তাদের সরবরাহকৃত ব্যাংক আ্যকাউন্টে জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতারকরা প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিকে সব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্লক করে দেয়। ডিবিপ্রধান হারুন বলেন, চক্রটি প্রতারণায় ব্যবহৃত ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো বিভিন্ন ব্যক্তির পাসপোর্ট জাল করে করেছে। বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের শত শত অ্যাকাউন্ট আছে এবং ওই সব ব্যাংক থেকে তারা ক্রেডিট কার্ড নিয়েছে। এসব ব্যাংকের চেক ও এটিএম কার্ড ব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকা তুলে নিত তারা। আর এই টাকা তোলা ও টাকা ভাগাভাগির কাজটি করতেন বিপ্লব। তিনি বিদেশি নম্বর ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে সরাসরি সব তদারক করতেন। বিপ্লবের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন সুমন হোসেন ওরফে ইমরান, মোহসিন হোসেন ওরফে শাওন ও ইমরান হাসান ইকবাল। বিপ্লবের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর, খিলক্ষেত ও কাফরুল থানায় মানি লন্ডারিংয়ের মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা রয়েছে। এ মামলায় তিনি একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছেন।

   

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর