বৃহস্পতিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

মরছে রাজশাহীর নদনদী

এভাবে যদি ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়তেই থাকে, তাহলে একসময় মরুকরণের দিকে ধাবিত হবে এ অঞ্চল

কাজী শাহেদ, রাজশাহী

মরছে রাজশাহীর নদনদী

একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা নদী এখন মৃতপ্রায়, ছবিটি গতকাল তালাইমারী খোজাপুর থেকে তোলা -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বর্ষা মৌসুমের খরস্রোতা পদ্মা নদী এখনই বালুচর। এ ছাড়া যেসব শাখা নদী আছে তার বেশির ভাগই চেনার উপায় নেই। পদ্মায় পানি না থাকার কারণেই হারিয়ে যেতে বসেছে এ অঞ্চলের নদনদীগুলো।

পদ্মাপারের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী শহরের তীরঘেঁষে চর জেগেছে। এ ছাড়া গোদাগাড়ী উপজেলার বালিয়াঘাটা থেকে সুলতানগঞ্জ পর্যন্ত মহানন্দা নদীর প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং সুলতানগঞ্জ মোহনা থেকে প্রেমতলী পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার পদ্মা নদীর ৬০ ভাগ এলাকায় পানি নেই। ৪০ ভাগ এলাকায় পানি থাকলেও গভীরতা খুবই কম।

এ অঞ্চলে নারদও ঐতিহাসিক একটি নদ। এর তিনটি প্রবাহ। এর প্রথম প্রবাহ রাজশাহীতে, দ্বিতীয় এবং তৃতীয়টি নাটোরে। রাজশাহী শহর থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শাহপুর গ্রামে পদ্মা নদী থেকে এর উৎপত্তি। শাহাপুর থেকে কাঁটাখালী, কাপাসিয়া, জামিরা, হলিদাগাছী, মৌগাছী, পুঠিয়ার তাতারপুর, বিড়ালদহ, ভাড়রা, কান্দ্রা পীরগাছা হয়ে নাটোরের ভিতর দিয়ে নন্দকুজা নদীতে পড়েছে। নারদের তৃতীয় প্রবাহটি নাটোরের বাগাতিপাড়ার আটঘরিয়া গ্রামের নন্দকুজা নদী থেকে উৎপত্তি লাভ করে ১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ধরাইল গ্রামে নারদের দ্বিতীয় প্রবাহের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। রাজশাহীতে এই নদীর প্রায় ৩৫ কিলোমিটার প্রবাহ পথে পাঁচটি নীলকুঠি ছিল। বর্তমানে এর উৎসমুখসহ প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশ বেদখল হয়ে ফসলি মাঠ ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে। বাকি অংশ এখনো নদীর আদলে মৃতপ্রায়। নদীর এই অংশ স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখলে নিয়ে দীঘিতে রূপান্তর করে মাছ চাষ করছে। মৌগাছী পূর্বপাড়া গ্রামের আনিসুর রহমান সরকার বলেন, তিনি বাবার কাছে শুনেছেন, এটি এ এলাকার একটি উল্লেখযোগ্য নৌপথ ছিল। মৌগাছী পশ্চিমপাড়া পেরিপাটনির ঘাট নামে একটি খেয়া ঘাট ছিল। এখন এর সবই স্মৃতি। সন্ধ্যা নদী নারদের একটি শাখা। এটির উৎসমুখ পুঠিয়া উপজেলার রঘুরামপুর বাগিচাপাড়ায়। পুঠিয়ার শিবপুর বাজারের পাশ দিয়ে বাঁশপুকুরিয়া, নন্দনপুর হয়ে কান্তার বিলে পতিত হয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। মুসা খান নদীর উৎসমুখ বড়াল নদ। নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার হাঁপানিয়া গ্রাম থেকে উৎপত্তি লাভ করে নদীটি রাজশাহীর পুঠিয়ার ঝলমলিয়া, কানাইপাড়া, নাটোরের আগদিঘা ছাতনি হয়ে ত্রিমোহনী নামক স্থানে গদাই নাম ধারণ করে আত্রাই নদীর সঙ্গে মিশে চলনবিলে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি জমলেও শুষ্ক মৌসুমে এই নদীতে পানি থাকে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা, পাগলা আর পুনর্ভবা নদী এখন মৃতপ্রায়। তলদেশ শুকিয়ে গেছে। মহানন্দার বেতবাড়িয়া মৌজায় দখল করা হয়েছে নদীর প্রায় অর্ধেক। এতে পরিবর্তন হয়েছে স্বাভাবিক গতিপথ।

নওগাঁয় আছে ছয়টি নদনদী। আত্রাই, ছোট যমুনা, তুলসীগঙ্গা, শিব, পুনর্ভবা ও নাগর। জেলার অন্যতম নদী ছোট যমুনা ও তুলসীগঙ্গায় এক সময় সারা বছর পানি থাকত। এখন সামান্য পানি। আত্রাই ও পুনর্ভবা পানির অভাবে শুকিয়ে গেছে। বগুড়া শহরের বুকচিরে প্রবাহিত করতোয়া দূষণ-দখল, ভরাট, প্রবাহ না থাকায় এখন মরা নদী। রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম শেখ জানান, রাজশাহী পানিবিজ্ঞান উপবিভাগের আওতায় থাকা রাজশাহী বিভাগের ১৩টি প্রধান নদীর মধ্যে ১১টি নদীর তলদেশ শুকিয়ে গেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, নদীর ধর্মই হচ্ছে পরিবর্তন। নদীর গতিপথ পরিবর্তনই হচ্ছে তার বৈশিষ্ট্য। সেদিক থেকে বলা যায়, নদী সবসময়ই তার গতিপথ পরিবর্তন করে। এখন যেমন শহর থেকে নদীর গতিপথ সরে যাচ্ছে। শহরের পাশেই বড় বড় চর পড়ছে। তার ঠিক উল্টোটা ঘটছে নদীর ওই পাশে। নদীর ওই পাশে চরখানপুর ও চরখিদিরপুরে ভাঙন হচ্ছে। ভাঙতে ভাঙতে ওই পাশে বিলীনের পথে। ফলে পানির প্রবাহ ঠিক থাকা গুরুত্বপূর্ণ। পানির প্রবাহ ঠিক না থাকলে এইরকম ভাঙা-গড়া চলতেই থাকবে। আর আমরা প্রতিনিয়ত দুরাবস্থার সম্মুখীন হব। এ জন্য পানির প্রবাহ বাড়াতে হবে। আর এ হিসাবটাও করতে হবে পুরো গঙ্গা রিভার বেসিন অনুযায়ী। শুধু ফারাক্কা থেকে কত কিউসেক পানি আসছে, তার ওপর বিষয়টা নির্ভর করে না।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। আবার পদ্মায় পানির প্রবাহ ঠিকমতো না থাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর চাপও পড়ছে। ফলে পানির লেভেল নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে যদি ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়তেই থাকে, তাহলে এক সময় মরুকরণের দিক ধাবিত হতে পারে এ অঞ্চল। তাই এখনই পদ্মার পানির প্রবাহ নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর