বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

কাঁদলেন কাঁদালেন তারা

চাইলেন স্বজন হত্যার বিচার

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদ্রোহ দমনের নামে ১৯৭৭ সালে সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের কারাদ-, চাকরিচ্যুতি ও অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার দাবি করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের অবরোধ চলাকালে পেট্রলবোমায় অগ্নিদগ্ধরা দুর্বিষহ জীবনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাঁদলেন এবং কাঁদালেন সবাইকে। গতকাল গণভবনে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের হাতে নির্বিচারে নিহতদের পরিবার এবং বিএনপি-জামায়াতের আগুনসন্ত্রাসে নিহতদের স্বজন ও আহতদের হাতে প্রধানমন্ত্রীর ঈদ উপহার তুলে দেওয়ার আগে স্মৃতিচারণা করে বক্তৃতা করেন তারা। এ সময় হলরুমজুড়ে ছিল পিনপতন নীরবতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ সময় বারবার টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে দেখা যায়। উপস্থিত অনেকেই ধরে রাখতে পারেননি তাদের চোখের পানি। এ সময় এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোহবান গোলাপ এমপির পরিচালনায় অনুষ্ঠানে প্রথমে ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে কারাদ-, চাকরিচ্যুতি ও অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পরিবারের ওপর একটি এবং ২০১৩-১৪ সালে পেট্রলবোমা হামলার শিকারদের ওপর দুটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত সার্জেন্ট দেলোয়ার হোসেনের সহধর্মিণী নুরুন্নাহার বেগম, তার সন্তান নূরে আলম, ফাঁসিতে দ-প্রাপ্ত সার্জেন্ট মোশরাফুল আলমের কন্যা মাকসুদা পারভীন রিমনা অনুষ্ঠানে অনুভূতি প্রকাশ করেন। মাকসুদা পারভীন রিমনার বক্তৃতায় পুরো অনুষ্ঠানজুড়ে নীরবতা দেখা যায়। তার বক্তব্য শুনে মঞ্চ ছেড়ে উঠে এসে সান্ত্বনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৩ সালে বোমা হামলায় দুই হাত হারানো এসআই মো. মকবুল হোসেন এবং ২০১৫ সালে পেট্রলবোমা হামলায় আহত সালাউদ্দিন ভূঁইয়ার অগ্নিদগ্ধ হয়ে মুখ বিকৃত হয়েছে। অগ্নিসন্ত্রাসের আর্তনাদ অনুষ্ঠানে তারা অনুভূতি প্রকাশ করেন। বিমান বাহিনীতে কর্মরত সার্জেন্ট মোশারফকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারেন জিয়াউর রহমান এমনটা উল্লেখ করে তার কন্যা মাকসুদা পারভীন রিমনা বলেন, ‘আমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো অন্য অনেকের মতো পড়ালেখা করে বিরাট কিছু হতে না পারলেও অন্তত একটা কিছু করে খেতে পারতাম। কিন্তু খুনি জিয়া আমার বাবাকে অকারণে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারে। এরপর কত কষ্টে জীবন কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একদিকে বাবা হারানোর শোক, অন্যদিকে মানবেতর জীবন। মানুষের কাছে বলতে গেলে মানুষ আমাকে বলে, আমি নাকি অভিনয় করি। কেউ বলে পাগলি মেয়ে।’ তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মানবতার মা। আমার বুকে অনেক কষ্ট। আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। কী ভাষায় আমি আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাব সে ভাষা আমার জানা নেই। শুধু বলব, আমাদের দুঃসময়ে আপনি আমাদের কাছে ডেকেছেন। খোঁজখবর রাখছেন। এর প্রতিদান আল্লাহ আপনাকে দেবেন।’ এ সময় তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রীকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চেয়ার থেকে উঠে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দেন। সার্জেন্ট মোশারফের মেয়ে এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন। হলরুমজুড়ে নেমে আসে নিস্তব্ধতা। এ সময় অনেকেই কান্নায় চোখ মুছতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর সামনে অনুভূতি প্রকাশ করেন ’৭৭ সালে স্বামীহারা সার্জেন্ট দেলোয়ারের স্ত্রী নূর নাহার বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে কোনো কারণ ছাড়াই জিয়াউর রহমান হত্যা করেন।

আমার পরিবারকে না জানিয়ে ফাঁসি দেন এবং কবর কোথায় দেন সেটাও বলেননি। এত দিন আমরা জানতে পারিনি আমার স্বামীর কবর কোথায়। এখন অনেকে লেখালেখি করছেন তারা জানাচ্ছেন কবর আজিমপুর কবরস্থানে।’ তিনি এ-সংক্রান্ত একটি রিট করেছেন এ সময় সেই রিটের অগ্রগতির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চান। তিনি বলেন, ‘এ ছাড়া ওই সময় আমার স্বামীসহ যাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়েছে, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার প্রস্তাব করছি, যা দেখলে খুনি জিয়াকে মানুষ ধিক্কার জানাতে পারবে।’ নূর নাহার বেগমের সন্তান তার পাশে এসে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘একজন সন্তান হিসেবে এটা কষ্টের যে পিতার কবরটা কোথায় আছে তা জানতে না পারা। এমন জঘন্য কাজ যিনি করেছেন আমরা তার বিচার চাই।’

২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার দাবি করে রূপগঞ্জের সালাউদ্দিন অনুভূতি প্রকাশে বলেন, ‘আমি যখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলছি, ঠিক তখন আমার সামনে একটা সুস্থ মানুষের ছবি আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, সেটা আমি। আর একই ফ্রেমের নিচে ঝলসে যাওয়া ছবিটাও আমার। দেখুন, আমাকে কী করে দেওয়া হলো। আমি একটা সাধারণ মানুষ। কেন আমার এত বড় ক্ষতি করা হলো। আমি খুবই দুঃখী মানুষ। কিন্তু ১৯৭৭ সালে বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের অনৈতিকভাবে ফাঁসি দিয়ে হত্যার গল্প যখন কারও স্ত্রী, কারও সন্তানের মুখে শুনছিলাম, তখন নিজের দুঃখের কথা ভুলে গেছি।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সালাউদ্দিন বলেন, ‘আপনার কাছে আমার কিছু চাওয়ার নেই। আপনার কারণে আমি সুচিকিৎসা পেয়েছি। এখনো সমস্যায় পড়লে আপনার সহায়তা পাই। আপনি মানবতার মা। আমার মতো অনেককে আগলে রেখে দেশটাকে পরিচালনা করছেন। তাই দেশের মানুষ চায় আপনি বারবার দেশের নেতৃত্ব দিন, আমিও চাই।’

ওই সময় অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়ে দুই হাত কবজি পর্যন্ত হারান পুলিশের এসআই মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘কেবল আমি পুলিশে যোগ দিয়েছি। তখনো বেতন হয়নি। চাকরির ১ মাস ১১ দিনের মাথায় অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হই। আমার বাঁচার কথা ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই তিনি সে সেময় আমার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। আমি তো পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য। এখনো চাকরি করছি। পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে আমি গর্বিত। ২০১৪-১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের তা-বে আমাদের পুলিশ বাহিনীর অনেকগুলো মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পুলিশ দেশের জন্য জীবন দেয়। দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আগামীতেও প্রাণ দিতে প্রস্তুত।’ তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। আপনি প্রয়োজন মনে করে আজ আমাদের ডেকে এনেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার সন্তান আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমার হাত কোথায় গেল, আমার হাতের অবস্থা এমন কেন। আমি কোনো জবাব দিতে পারি না।’ এ সময় তিনি দুই হাত উঁচু করে বলেন, ‘আমার সন্তান আছে, কিন্তু দুই হাত দিয়ে আদর করতে পারি না। এর চেয়ে কষ্ট আর কী হতে পারে! পুলিশে চাকরি করা কি অপরাধ ছিল? ওরা এখনো আমাকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দেয়, আমাকে মেরে ফেলবে। কীভাবে চাকরি করি সেটাও দেখে নেবে। আমি কি বিচার পাব না মাননীয় প্রধানমন্ত্রী? বিচার দেখে যেতে চাই।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর