রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে জেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হামিদের করা মামলায় বিএনপির পাঁচ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়েছে। ভুক্তভোগী নেতারা এখন বাদীর বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন। শুধু তা-ই নয়, ওই নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে মানববন্ধনও করেছেন।
শুধু গোদাগাড়ীতে নয়, জেলার বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া মামলায়ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় মামলা করছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনো ঘটনা না ঘটলেও মামলা হচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করেছেন। আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম না দিতে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে বলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগের মামলায় গণ আসামি করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ঘটনা নিয়েও মামলা হচ্ছে এখন।
পুলিশ বলছে, মামলায় কাকে আসামি করা হবে না হবে তা বাদীর ওপরই নির্ভর করছে। মামলা রেকর্ডের আগে যাচাই-বাছাই করার সুযোগ হচ্ছে না। আর আইনজ্ঞরা বলছেন, অতি উৎসাহী হয়ে কেউ কেউ মামলায় গণআসামি করছেন। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এমন ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হন তা নজর রাখা উচিত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৯ আগস্ট থেকে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে মামলা হতে শুরু করেছে। ১৯ আগস্ট প্রথম মামলা হয় নগরীর বোয়ালিয়া থানায়। গত ৫ আগস্ট আলী রায়হান নামের এক শিবির নেতার নিহতের ঘটনায় করা এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও সদ্য সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে। মামলায় আসামি হিসেবে ৫০ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাত আসামি আরও ১০০০ থেকে ১২০০ জন।
রাজশাহীতে ৫ আগস্টের সংঘর্ষে আলী রায়হানসহ মোট দুজনের মৃত্যু হয়। অপর শিক্ষার্থী সাকিব আনজুমকে হত্যার অভিযোগে ২৩ আগস্ট রাতে বোয়ালিয়া থানায় আরও একটি মামলা হয়। এতেও আসামি করা হয় লিটনসহ ৪২ নেতা-কর্মীকে। অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা আরও প্রায় ৩০০ জন।
১৯ আগস্টের পর থেকে রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় প্রতিদিনই দুয়েকটি করে মামলা হচ্ছে। সব মামলাতেই গণহারে আসামি করা হয়েছে। প্রতিটি মামলায় অজ্ঞাত আসামিও করা হয়েছে ১০০ থেকে ২০০ জনকে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ভোট ডাকাতির অভিযোগেও এখন মামলা হতে শুরু করেছে। নগরীর বোয়ালিয়া, কর্ণহার ও গোদাগাড়ী থানায় এমন মামলা হয়েছে।
বিএনপির দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মামলার বাদী কে হবেন তা নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিতর্কিত কর্মকান্ড করে দলীয় নেতাদের কাছে সমালোচিত হওয়া ব্যক্তিরাও মামলা করতে যাচ্ছেন। রাজশাহী মহানগর মহিলা দলের বহিষ্কৃত যুগ্ম সম্পাদক সামসুন নাহার ২০১৮ সালের ঘটনায় সম্প্রতি মামলা করেছেন। সামসুন নাহার রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় ২০২৩ সালে তাকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তবে মামলার এজাহারে সামসুন নাহার এখনো দলীয় পরিচয় উল্লেখ করেছেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে রাজশাহী সদর আসনের বিএনপির প্রার্থী ও দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুকে ভোট দিতে বাধা দেওয়ার অভিযোগে বোয়ালিয়া থানায় তিনি মামলাটি করেছেন। এ মামলাতেও গণআসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া ওই সময় মিনুর বাড়ি ও নির্বাচনি ক্যাম্পে হামলার অভিযোগে আরও দুটি মামলা করেছেন তার বাড়ির কেয়ারটেকার।
সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী ও আয়েন উদ্দিনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখল করে প্রকাশ্যে ভোটডাকাতির অভিযোগ আনা হয়েছে। সাড়ে পাঁচ বছর আগের ঘটনার এসব মামলায় গণআসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে গত ২৫ আগস্ট বাদী হয়ে থানায় ৪৫ জনের নামসহ ৫০০-৬০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপজেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হামিদ বাবলু। বাবলুর বাড়ি গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের ফরাদপুর গ্রামে। এ মামলাটির প্রধান আসামি রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী। মামলায় ২৪ নম্বর আসামি করা হয়েছে গোগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলামকে। ২৫ নম্বর আসামি হয়েছেন ইউনিয়ন যুবদল নেতা বকুল হোসেন। ১৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে ইউনিয়ন যুবদল নেতা আবদুল বারীকে। মামলায় ২০ নম্বর আসামি হয়েছেন যুবদল নেতা শাহীন ও ৩৯ নম্বর আসামি করা হয়েছে ইউনিয়ন যুবদল নেতা সুমনকে। ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলা পরিষদের প্রধান গেটের সামনে।
মামলার আসামি গোগ্রাম ইউনিয়ন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম অভিযোগে বলেন, ‘গত ৩ আগস্ট সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে বাদী কৃষকদল নেতা আবদুল হামিদ বাবলুর সঙ্গে আমাদের কথাকাটাকাটি হয়েছিল। ফলে বাদী এলাকায় একক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে আমাদের নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে মামলায়। বাদী মামলা বাণিজ্য করতেই এ কাজটি করেছেন। আমরা দল থেকে তার বহিষ্কার দাবি করছি।’
নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মামলায় জড়ানোর অভিযোগের বিষয়ে বাদী উপজেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল হামিদ বাবলু বলেন, যারা নিজেদের এখন বিএনপি নেতা-কর্মী দাবি করছেন, তারা দিনে বিএনপি আর রাতে আওয়ামী লীগ করে। তাড়াহুড়া করে এজাহার দিতে গিয়ে হয়তো তাদের নামও মামলার আসামি হিসেবে চলে এসেছে। পুলিশের সঙ্গে কথা বলে তদন্তে তাদের নাম বাদ দেওয়া যেতে পারে।
রাজশাহীর বাঘা থানায় মামলা করেছেন কিশোরপুর গ্রামের জাহিদ হাসান। ওই মামলায় ১৪ নম্বর আসামি হিসেবে বাঘা প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামানের নাম লেখা হয়েছে। বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সিদ্দিক বলেন, ‘আসামি কে হবেন, না হবেন তা বাদীর ওপরই নির্ভর করে। মামলা হওয়ার পর তদন্তের সময় আমরা বাকিটা দেখব।’
জেলা জজ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদী বলেন, ‘কোনো অপরাধের বিচার পাওয়াটাই মামলার মূল উদ্দেশ্য। এখানে কাউকে হয়রানি করার জন্য গণআসামি করা ঠিক হবে না। তবে মামলা করাই তো শেষ কথা নয়। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত করবেন। তখন যেন মামলাগুলোর সতর্কতার সঙ্গে তদন্ত করা হয়। প্রকৃত দোষীদের বিরুদ্ধেই যেন অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, ‘আমার নামে এখন ৬৭টা মামলা, সব মামলাই গায়েবি। আমাদের অন্য নেতা-কর্মীদের নামেও অসংখ্য গায়েবি মামলা আছে। তারপরও আমরা গায়েবি মামলা সমর্থন করি না। কেউ হয়তো অতিউৎসাহী হয়ে এ ধরনের মামলা করছেন। এর দায় মামলার বাদীকেই নিতে হবে। আমরা বলছি, কাউকে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে যেন মামলার আসামি করা না হয়।’