রাজশাহী শহরের বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে উঠেছে বারনই নদী। এর প্রভাবে রাজশাহী ও নাটোরের সাতটি উপজেলার প্রায় তিন লাখ মানুষ ভুগছে। এ নদীর পানি ব্যবহার করলে জটিল ও ভয়াবহ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ছোঁয়াচে হওয়ার কারণে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
রাজশাহীর স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠন’ রাজশাহী ও নাটোরের সাতটি উপজেলায় সম্প্রতি একটি জরিপ চালিয়েছে। সংগঠনটির তথ্য অনুযায়ী, বারনই নদীর বিষাক্ত পানির কারণে প্রায় তিন লাখ মানুষ জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত। শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সের মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ বহন করতে না পারায় নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট আরও বেড়েছে। পাশাপাশি হুমকির মুখে পড়েছে নদীর জীববৈচিত্র্য। নদীর মাছ মারা যাচ্ছে। বিপন্ন হয়ে পড়েছে জেলে সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবিকা।
রাজশাহী শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকের অপরিশোধিত বর্জ্য, বিসিক শিল্প এলাকার বর্জ্য, বিভিন্ন মিলকারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত পানি, গৃহস্থালি বর্জ্য এবং পয়োনিষ্কাশনের বিষাক্ত পানি সরাসরি সিটি হাটের পাশের ড্রেন, পবা উপজেলার দুয়ারি খাল, পবা গাঙ্গপাড়া ও বায়া-মহনন্দখালী খালের মাধ্যমে নওহাটায় গিয়ে বারনই নদীতে মিশছে। ফলে নদীর পানি ভয়াবহভাবে দূষিত হচ্ছে। এই নদীর পানি ব্যবহার করে রাজশাহী ও নাটোর জেলার নদীপাড়ের গ্রামগুলোর মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা এ পানি দিয়ে গোসল, কাপড় কাচা, গৃহস্থালি কাজ ও কৃষিকাজ করছে। এতে দাদ, ফাঙ্গাস, স্ক্যাবিস, পাঁচড়া, শুকনো চুলকানি, চর্মদল ও জকইচসহ নানা জটিল চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় দিনের পর দিন এসব চর্মরোগ শরীরেই থেকে যাচ্ছে। অনেক মানুষ দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করছে।
নলডাঙা উপজেলার বাঁশিলা ইসলাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রুবিনা বেগম বলেন, ‘বাড়ির পাশে নদী। আমরা পানি ব্যবহার সাধারণত করি না। তা-ও মাঝে মাঝে হয়ে যায়। এতে আমার বাড়ির ছয়জন প্রায় দেড় বছর ধরে চর্মরোগে আক্রান্ত। ডাক্তার দেখিয়েছি। ওষুধে কাজ হচ্ছে না। আশপাশের মানুষেরও এটা আছে। মনে হয় আমরা দুনিয়ায় থেকেও জাহান্নামের আজাব ভোগ করছি।’
বাঁচার আশা সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি গোলাম মোস্তফা বিজলী বলেন, ‘শুধু পবা উপজেলার নওহাটা এলাকার নিম্নআয়ের কয়েক হাজার মানুষ বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত। আমরা গত ১৯ আগস্ট একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে ৫০ জনের চিকিৎসা দিয়েছি। এটা আক্রান্তের তুলনায় অতি সামান্য।’
রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. এসআইএম রাজিউল করিম বলেন, ‘বারনই নদীর পানি ব্যবহার ও মাছ খাওয়ার কারণে মানুষ চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। প্রয়োজনে জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনা করা হবে। আপাতত এই পানির ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহী সিটি করপোরেশন ও ওয়াসাকে বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয় দেখা দেবে। রাজশাহী ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী পারভেজ মাসুদ বলেন, ‘মানুষকে চর্মরোগ থেকে বাঁচাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আমরা বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছি। সরকারের কাছে একটি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে। জাইকার সঙ্গে আলোচনা চলছে।’