ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার দমদমের বাসিন্দা এক হিন্দু নারীর শরীরে করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। এরপরই তাকে ১৪ দিনের কোরান্টাইন সেন্টারে পাঠানো হয়। কিন্তু তার দুই সদ্য জমজ শিশু সন্তানকে কীভাবে সামলানো হবে তা ভেবেই তখন দিশেহারা অবস্থা পরিবারের অন্য সদস্যদের। নিজের সন্তানদের কথা ভেবে অসহায় বোধ করতে থাকেন তাদের বাবাও। এমন অবস্থায় স্থানীয় আয়া সেন্টাগুলিতেও খোঁজ চালায় তাদের পরিবার। কিন্তু করোনার কথা শুনে তারা কেউই ওই পরিবারে কাজের লোক পাঠানো রাজি হয়নি।
কোন সুরাহা না হওয়ায় এরপর সোশ্যাল মিডিয়ায় ওই দুই সন্তানকে দেখভালের জন্য আর্জি জানিয়ে লোক খোঁজা হয়। কিন্তু ওই অসহায় পরিবারকে সহায়তা করার জন্য তখনও কাউকেই এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। এক সময় ওই পরিবার যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিল, তখনই ৩৬ বছর বয়সী ফিরদোস মুন দেবদূতের মতো হাজির হন। ফোনে দমদমের ওই পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার পর তাতে সম্মতি মেলায় প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এক সপ্তাহ আগে ওই অপরিচিত হিন্দু বাড়িতে হাজির হন। আর সেই থেকেই গত কয়েকদিন ধরে হাসি মুখে শিশু সন্তানের দায়িত্ব সামলে যাচ্ছেন ফিরদোস।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার পৈলানের বাসিন্দা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা অবিবাহিত ওই মুসলিম নারীর সন্তান সামলানোর অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথম অবস্থায় বেশ অস্বস্তিতে পড়েন। যদিও তিন দিনের মধ্যেই বাচ্চা সামলানোর সমস্ত কৌশলই আয়ত্ত করে ফেলেন। তাদের কোলে নেওয়া, তিন ঘণ্টা পর পর সময়মতো বেবি ফুড খাওয়ানো, তাদের পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, ঘুম থেকে ওঠার পর তাদের সাথে খুনসুটি করা-সবটাই নিজের হাতে সামলাচ্ছেন ফিরদোস মুন।
যদিও মেয়ের এই সিদ্ধান্তে ঘোরতর আপত্তি জানায় ফিরদোসের বাবা-মা। তবে মানবিকতার খাতিরে সব বাধা তুচ্ছ করে ওই হিন্দু পরিবারকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেন ফিরদোস।
ফিরদোস জানান, আমি কখনও ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিচার করি না। আমি মানবিকতায় বিশ্বাসী। আমি যেটা করেছি সেটা মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি যখন ফেসবুকে ওই পোস্ট দেখি, আমি ভেবেছিলাম যে ওই শিশু দুইটিকে সহায়তার জন্য একজোড়া যত্নশীল হাত প্রয়োজন এবং আমি সেটাই করেছি।
ফিরদোস আরও জানান, আমার বাবা-মা উভয়েই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। তারা আমার স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ আমি যে পরিবারে বাচ্চা সামলানোর দায়িত্বে রয়েছি-তাদের পরিবারের কোভিড-১৯ সংক্রমণ ধরা পড়েছে। কিন্তু আমার বিবেক সায় দেওয়ায় গত রবিবার ঘর ছাড়ি।
ওই জমজ সন্তানের দাদি জানান, আমার ছেলে প্রতিদিন তার কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছিল। ফলে তার স্ত্রী বা সন্তানদের যাতে কোন সমস্যা না হয় সেদিকে তাকিয়েই আমার ছেলে আলাদা থাকতে শুরু করে। আমার স্বামীও বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। আমারও বয়স হয়েছে ফলে দুই নাতনিকে আমার পক্ষে সামলানো সম্ভব নয়। ফলে ফিরদোস যখন আমাদে ফোন করে জানালেন যে তিনি মুসলিম এবং আমাদের দুই বাচ্চাকে সামলানোর দায়িত্ব নিতে চান-তখন আমি দ্বিতীয়বার ভাবিনি। আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই।
বয়স্ক ওই হিন্দু নারী আরও জানান, আমাদের পরিবারে করোনা ধরা পড়ার পর কেউই আমাদেরকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসেনি। সেখানে ফিরদোসের মতো একজন মুসলিম নারী সমাজের কাছে আদর্শ উদাহরণ হয়ে দাঁড়ালো।
যাদের পরিবারে কোভিড রোগী আছে- ফিরদোসের এই মানসিক দৃঢ়তা-অন্য মানুষদেরও সেই সব পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর মতো সাহস যোগাবে বলেও অভিমত জমজ সন্তানের ওই বৃদ্ধা দাদির।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা