রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২১ ০০:০০ টা

হিলিতে করোনাকালে ৫০০ বাল্যবিয়ে

করোনায় চাকরি হারিয়ে অনেকে পরিবার নিয়ে চরম বিপর্যয়ে

হিলি প্রতিনিধি

হিলিতে করোনাকালে ৫০০ বাল্যবিয়ে

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা হিলিতে করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ দেড় বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় উপজেলার সব স্কুল-কলেজ মিলিয়ে ৫০০ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। ২০০ ছেলে শিক্ষার্থী কাজের সন্ধানে গার্মেন্ট, রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েছে। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হওয়ায় এখন বিদ্যালয় খুললেও উপস্থিতির হার অনেকটা কম। তবে কিছুদিন গেলে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে দাবি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের। হাকিমপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ৩টি কলেজ, ৩টি স্কুল, ১৮টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৩টি ফাজিল ও দাখিল মাদরাসা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় করোনাকালীন সময়ে ৫০০ শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ে ও ২০০ ছেলে শিক্ষার্থী বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। হিলির জালালপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বিলকিস আকতার জানায়, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধের পর আবারও স্কুলে আসতে পেরেছি এ জন্য খুব ভালো লাগছে। কিন্তু আবার বেশ মন খারাপ হচ্ছে এ জন্য যে আমাদের অনেক বান্ধবীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা খুব ভালো ছাত্রী ছিল। আগে একসঙ্গে আমরা ক্লাস করতাম। আমাদের ভালো বন্ধু ছিল তারা। এখন স্কুলে আসে না। পড়ালেখা শেষ না করেই অভিভাবক তাদের বিয়ে দিয়েছেন। একই বিদ্যালয়ের অপর ছাত্র শরিফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন পর স্কুলে আসতে পারায় ও ক্লাস করতে পারায় আমরা খুশি। আমরা আশা করছি পড়ালেখার যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু আগে আমাদের অনেক বন্ধু ছিল সবাই একসঙ্গে ক্লাস করেছি কয়েকজন বেশ ভালো ছাত্র ছিল যাদের অনেকেই আজ স্কুলে নেই। যারা বর্তমানে গার্মেন্ট, রাজমিস্ত্রিসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেছে। এর কারণে আমরা তাদের খুব মিস করছি, স্কুল খুলছে জানানো হলেও তারা আর আসছে না। হিলির জালালপুর দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আশরাফুল সিদ্দিক বলেন, আগে আমাদের স্কুলে যত সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ছিল করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধের পর এখন স্কুল খোলার পরে অর্ধেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসছে। দীর্ঘদিন বন্ধের কারণে অনেক ছাত্র বিভিন্ন কাজে চলে গেছে যারা আর ফিরে আসছে না। তাদের টাকা উপার্জনের ওপর একটা মায়া বা লোভ চলে এসেছে। আবার মেয়েরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে বসে থাকার কারণে অনেক বাবা মনে করেছেন কবে স্কুল খুলবে না খুলবে এ সময়ে ভালো একটি ছেলে পেয়েছি বিয়েটা দিয়ে দেই এ রকম করে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। যার কারণে এখন অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে নেই, তবে এখন যদি নিয়মিত স্কুলে ক্লাস হয় তাহলে এই পরিস্থিতি অনেকটা কেটে ওঠা যাবে। একই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান বলেন, করোনা মহামারীর মাঝে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে শিক্ষা খাত। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, আগে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাণচাঞ্চল্য ছিল যে পরিবেশটা আমরা তৈরি করেছিলাম সেটি অনেকাংশেই ভেঙে পড়ার উপক্রম। অনেক চেষ্টা করেছি আমরা তারপরও আর্থিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। মেয়েকে নিয়ে তাদের অভিভাবকরা যতটা আর্থিক ভাবনায় পড়ে তার চেয়ে বেশি ভাবনাই পড়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে। আমরা যেন প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল থেকে শহরাঞ্চল পর্যন্ত সবখানেই মেয়েদের নিরাপত্তা পাই। বাংলাহিলি পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তফা কামাল বলেন, অনুপস্থিত বলতে আমার স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী রয়েছে যারা অত্যন্ত গরিব, করোনার কারণে দীর্ঘসময় ছুটির ফাঁকে তারা হয়তো বা বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ দোকানপাট কর্মচারী হিসেবে অনেকে কাজ করছে। এমনো শিক্ষার্থী আছে তার হয়তো বাড়িতে ঠিকমতো খাবার নেই এ রকম লজ্জার কারণে স্কুলে আসে না। বাংলাহিলি সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমান বলেন, করোনায় অনেকে শিক্ষার্থীর বাবা-মা চাকরি হারিয়ে পারিবারিকভাবে বিপর্যয় নেমে আসে।

যেহেতু এটা দীর্ঘ দেড় বছর ধরে গড়ে ওঠা একটা অভ্যাসের ব্যাপার আবার অনেক শিক্ষার্থী হয়তোবা দূরে আছে কেউ ঢাকায় গেছে, আবার কেউ কেউ বিভিন্ন জেলায় চলে গেছে। এ কারণেই বিদ্যালয়ে ছাত্রীর উপস্থিতি কম হতে পারে।

 দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে তাদের যে পড়ালেখার ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাব তবে এক বছরের কোর্স তো আর তিন মাসে শেষ করা যাবে না তবে আমরা চেষ্টা করব। হাকিমপুর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বোরহান উদ্দিন বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘ দেড় বছর ধরে তারা স্কুলে আসেনি। সে থেকে আবারও স্কুলে ফেরত আসা একটু দুরূহ ব্যাপার। আস্তে আস্তে এটার অবশ্যই পরিবর্তন হবে ও ছেলে মেয়েরা অবশ্যই স্কুলে আসবে। আমাদের এই উপজেলাটি একটি সীমান্ত ঘেঁষা ও দরিদ্রপ্রবণ উপজেলা। সেক্ষেত্রে বিশেষ করে ছাত্রীরা অনেকে গার্মেন্টের চাকরির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে আবার অনেকের বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। সে জন্য মেয়েরা হয়তো বা সব ফেরত আসবে না। কিন্তু আনার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

সর্বশেষ খবর