পাবনার বেড়ায় অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বাড়ি বীর নিবাস বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজ পরিবারের নামে বীর নিবাসের বাড়ি নিয়েছেন বরাদ্দ কমিটির সদস্য সচিব বেড়া উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। অনৈতিক এ কাজে সহযোগিতা করেছেন উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু ও বেড়ার নির্বাহী কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন থেকে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মুজিববর্ষে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস নামে সারা দেশে ৩০ হাজার একতলা পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে সরকার। নীতিমালা অনুসারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সমাজসেবা কর্মকর্তা সদস্য সচিব হিসেবে বরাদ্দ কমিটি করে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বাছাই করবেন। কিন্তু রক্ষকই ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছোট ভাই শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের এই বাড়ি বরাদ্দ নিয়েছেন বেড়া উপজেলা সমাজসেবা অফিসার রফিকুল ইসলাম। নির্মাণ শেষে এখন তা হস্তান্তরের অপেক্ষায়। বীর নিবাস বরাদ্দ নীতিমালায় বলা হয়েছে, সরকারি আবাসন কিংবা ভূমির সুবিধা পাননি এমন অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা পরিবার বীর নিবাসের বরাদ্দ পাবেন। যুদ্ধাহত, প্রতিবন্ধী হলে অগ্রাধিকার পাবেন। পাশাপাশি আবেদনকারীকে অবশ্যই অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল হতে হবে। কিন্তু বেড়া উপজেলার কাজীরহাটে বাড়ি বরাদ্দ পাওয়া সমাজসেবা কর্মকর্তার ভাই শফিউদ্দিন ফকির অসচ্ছল নন, সরকারি চাকুরিজীবী। অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ পরিবারে বীর নিবাস বরাদ্দ দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। সরেজমিন দেখা যায়, শফিউদ্দিন ফকিরের জন্য বীর নিবাসের বাড়ি নির্মাণ শেষ হয়েছে। সে বাড়ির পাশেই তিনতলা বাড়িতে থাকেন তার বড় ভাই উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম। শফিউদ্দিন জানান, তাদের পিতা মৃত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন ফকিরের নামে পরিবারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ কমিটির কাছে বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ চান তারা। মৃত পিতার পৈতৃক জমিতে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় তারা মাসুমদিয়া ইউনিয়নে জায়গা কেনেন। সেখানেই বীর নিবাসের বাড়ি বন্দোবস্ত দিয়েছে বরাদ্দ কমিটি। সরকারি ভালো বেতনে চাকরি করেও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ঘর কীভাবে পেলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে ইউএনও স্যার বলতে পারবেন। বরাদ্দপ্রাপ্তির পর বাড়ি ভোগদখলে শফিউদ্দিনকে ক্ষমতা দিয়ে হলফনামা করেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। এ সময় আবুল হোসেনের দ্বিতীয় স্ত্রী বরাদ্দ দাবি করলে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, ইউপি চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে প্রভাব খাটিয়ে বীর নিবাসের মালিকানাস্বত্ব ছাড়তে লিখিত দলিল করে নেন প্রথম পক্ষের সন্তানেরা, অভিযোগ হালিমা খাতুনের। হালিমা খাতুন বলেন, মুক্তিযোদ্ধার বিধবা স্ত্রী হিসেবে বাড়িপ্রাপ্তিতে আমার অগ্রাধিকার রয়েছে। আমার নাবালিকা মেয়েও আছে। প্রথম পক্ষের ছেলেরা সরকারি চাকরি করে।
তাদের অবস্থা ভালো। কিন্তু বাড়ি বরাদ্দের কথা শুনে আমি ইউএনও অফিসে যোগাযোগ করি। কিন্তু তারা আমাকে বরাদ্দ দেয়নি, শফির নামে বাড়ি বরাদ্দ হবে বলে জানায়। পওে ইউএনও, উপজেলা চেয়ারম্যান, রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যানসহ ইউনিয়ন পরিষদে বৈঠক করে আমার মেয়ের নামে ১ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে দলিলে সই করিয়ে নেয়। বাধ্য হয়েই তাদের সিদ্ধান্ত আমাকে মেনে নিতে হয়েছে। রূপপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মাজহারুল ইসলাম মোহন বলেন, উপজেলা কমিটির কাছ থেকে বীর নিবাসের বরাদ্দ নেওয়ার পর মৃত আবুল হোসেন ফকিরের প্রথম পক্ষের ছেলেদের সঙ্গে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর বিরোধ শুরু হয়। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদে উভয় পক্ষকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নাবালিকা মেয়ের জন্য ১ লাখ টাকা ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও বিয়ের সময় সহযোগিতার শর্তে বীর নিবাসের মালিকানা প্রথম পক্ষের মেজো ছেলে শফিউদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। বীর নিবাসের বাড়ি বরাদ্দ নেওয়ায় অনিয়ম হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুরো প্রক্রিয়াই অনিয়মের মধ্যে হয়েছে। কারণ, আবুল হোসেন ফকির মুক্তিযোদ্ধাই নন। তিনি ভারতেও প্রশিক্ষণে জাননি। কোনো দিন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন বলেও শুনিনি। অথচ এসব পরিবারের লোকজন মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা ভোগ করছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত হচ্ছে, আমি এর বিপক্ষে। বীর নিবাস নিয়ে সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুলের পারিবারিক সালিশ শেষে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর নিকট থেকে বীর নিবাসের দাবি না করার অঙ্গীকারনামা দলিল করে নেওয়া হয়। সে দলিলে সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর দেন বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল হক বাবু। এ বিষয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান বলেন, মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আবুল হোসেন ফকিরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে প্রথম পক্ষের সন্তানদের বীর নিবাস নিয়ে মতবিরোধ তৈরি হয়। পরে উভয় পক্ষ বসে বিষয়টি সমঝোতা করে নিয়েছে। বৈঠকে আমি অসচ্ছল বিধবা স্ত্রীর বিষয়টি বুঝতে পারিনি। কিন্তু উভয় পক্ষ সমঝোতা করে স্ট্যাম্প করে। সেখানে সবার অনুরোধে আমি সাক্ষী হিসেবে স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর করেছি। এত কিছু না বুঝে, সবাই চেয়েছেন তাই আমিও স্বাক্ষর করেছি। এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, বীর নিবাসের আবেদন যারা করেছিলেন, তাতে আবেদন কম ছিল। আবার যারা আবেদন করেছিল অনেকেরই প্রয়োজনীয় জমি নেই। আমার পরিবারে বীর নিবাস বরাদ্দ আমি একা দেইনি। কমিটি যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি কমিটির বিষয়। বীর নিবাস বরাদ্দ কমিটির সভাপতি ও বেড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সবুর আলী বলেন, কোনো অনিয়ম করে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। সবার মতামতের ভিত্তিতেই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। শফিউদ্দিনের কোনো নিজের বাড়ি নেই। অসচ্ছল হিসেবেই তাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তিনি সরকারি চাকরিজীবী উল্লেখ করা হলে তার কোনো সদুত্তর দেননি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেন বলেন, সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা বা পরিবারের বীর নিবাস বরাদ্দপ্রাপ্তির সুযোগ নেই, বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান।