হাউলি প্রথাটি প্রাচীনকাল থেকে পঞ্চগড়ের কৃষকের জীবন প্রনালীর সাথে জড়িয়ে আছে। ধানের বীজ রোপন অথবা ক্ষেত থেকে ধান ঘরে তোলার আনন্দের সাথে জড়িয়ে আছে হাউলির বর্ণিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। গ্রামের ছোট বড় সব কৃষকই হাউলির আয়োজন করে থাকে। এ নিয়ে সারা বছরই গ্রাম আর প্রতিবেশীদের মধ্যে চলে ঠাট্টা মশকরা। কার হাউলিতে লোক বেশী হলো আর কার বাড়িতে ভূরিভোজ কেমন হলো এ নিয়েই চলে সারা বছর আলোচনা। এই আলোচনাতেই কৃষক পরের হাউলি আয়োজনটা কেমন হবে তা ঠিক করে নেয়। হাউলির মূল প্রতিপাদ্য একজন আরেক জনের পাশে দাঁড়ানো।
বাংলাদেশের এনসাইক্লোপিডিয়ায় চমকপ্রদ এই প্রথাটির ইতিহাস এখনও যুক্ত হয়নি। হাউলি শব্দটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি বাংলা একাডেমীর ডিকশনারীতে। অথচ পঞ্চগড়ের প্রতিটি মানুষই হাউলির সুপ্রশিদ্ধ ইতিহাসের সাথে সুপরিচিত। অবশ্য নতুন জেনারেশনের কাছে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই প্রথা।
লোকমুখে জানা যায় এ অঞ্চলে শ্রাবন অথবা ভাদ্র মাসের দিকে অর্থের অভাবে বা অন্য কোন কারণে কোন কৃষক ধানের চারা রোপণ শেষ করতে না পারলে উক্ত কাজ শেষ করে দেয়ার জন্য গ্রামের সবাইকে আহ্বান জানায়। একই ভাবে আহ্বান জানায় অগ্রাহায়ন ও পৌষমাসে ধান কেটে দেয়ার জন্য। এই আহ্বানে কেউ বাদ পড়েনা। ধনী গরীব বিবেচনা হয়না। কৃষকের আহ্বানে সাড়া দেয় সবাই । বিনা পারিশ্রমিকে ঐ কৃষকের বাকি কাজটুকু করে দেয় প্রতিবেশীরা একসাথে। হাউলির দিনে দুই বেলা ভূরিভোজের আয়োজন হয়।
হাউলিতে গ্রামের ছোট বড় সবাই অংশ নেয়। ঐদিন সারাদিন অনেকগুলো মানুষ একসাথে মিলিত হয় বলেই আনন্দের সীমা থাকেনা। বৃষ্টি, কাঁদা বা প্রচন্ড শীত কোন কিছুই তাদের আনন্দকে ম্লান করতে পারেনা। সারাদিন গান গল্প আর হাসি ঠাট্টা দিয়েই কাজের সমাপ্তি ঘটে। তারপর সবাই মিলে আঙ্গিনা বা মাটির ধাপে (বারান্দা) বসে আহার করার মজা সারা বছর কেউ ভুলতে পারেনা। হাউলি আয়োজক কৃষকের পরিবারের সবাই সেদিন আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকে।
কিন্তু সময়ের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে কৃষকের আনন্দময় প্রাচীন এই হাউলি প্রথা। পঞ্চগড়ের কয়েকজন তরুণ উদ্যোগী হয়ে ২০১৫ সালে হাউলী নামের একটি ছোট কাগজ বের করে। হাউলীর সম্পাদক শৈশব রাজু বলেন ‘অর্থনৈতিক দৌড় আর জাগতিক ব্যস্ততার কারণেই অনেক প্রথার সাথে বিলুপ্তির পথে এই প্রথাও। গ্রামীন পর্যায়ে নগরের নির্দয় ছোয়ায় হাউলি এখন বিলুপ্তির পথে। তবে মুল্যবোধের অবক্ষয়ের এই সময়ে প্রথাটিকে টিকিয়ে রাখতে পারলে সমাজে এর দারুণ প্রভাব পড়বে।’
গত শুক্রবার সদর উপজেলার বলেয়া পাড়া গ্রামের কৃষক আশির উদ্দীন ঘুটু তার দেড় বিঘা জমিতে আমন লাগানোর জন্য আয়োজন করে হাউলির। মাঠে গিয়ে দেখা যায় প্রায় ৩০ জন লোক রোয়া বুনছে। অনেকেই তখন গান গাইছিল। তাদের একজন জয়নাল আবেদিন জানান, ঘুটু ভাই রোয়া বুনা শেষ করতে পারেনি। তাই আমাদেরকে হাউলি দেয়ার দাওয়াত দিলে আমরা তার রোয়া বুনে দিচ্ছি। ভজনপুর এলাকার কৃষক রফিজ উদ্দিন আহমেদ জানান 'হাউলির চলটা (প্রথা) উঠে গেল বারে (বাহে)। এলা আর কাহাকো সুখ দুখত পাওয়া যায়না। আগুন গ্রামডাত হাঁক দিলে সবাহে আসে হাউলি দিত। এলা তো কাহারো সময় নাই।'
দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক আলী ছায়েদ বলেন, 'হাউলি হচ্ছে কৃষকদের ক্রান্তিকালে প্রয়োজনীয় একত্রিত কার্যক্রম। এটি বাঙালীর মানবিক মূল্যবোধের একটি ইতিহাস। এই প্রথাটিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত।'
বিডি প্রতিদিন/৬ আগষ্ট ২০১৬/হিমেল-১৩